আমি নিশ্চিত, ও আমাকে ভালোবাসে। বাসেই। ও মানে আমার ডিসট্যান্ট কাজিন হিমেল। লুকোতে চাইলেও একদম লুকোতে পারেনি। ওর চোখ বিট্রে করেছে, বলে দিয়েছে আমাকে। যেদিন থেকে ব্যাপারটা শুরু হলো, ঠিক বুঝতে পারলাম, হিমেলের সঙ্গে আমার সেই সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কটা আর নেই। হিমেল আর এখন আগের মতো যখন-তখন আমাদের বাসায় আসে না, কথা বলতে গেলে গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে যায়। চোখ তুলে তাকাতেও কেমন সংকোচ বোধ করে।
আমি বুঝলাম, এর নাম প্রেম। সহসাই হিমেলের দেহদৌর্বল্য দেখা দিয়েছে। আমার সামনে এলেই ওর হাঁটু কাঁপতে শুরু করে। আমি অস্বস্তিবোধ করি ওর অপ্রতিভ ভাব দেখে। তবে ফিরিয়ে দিতে পারি না। বেশ বুঝতে পারি, ও কুলকুল করে ঘামছে। আর ঘামাচ্ছে আমাকেও। হিমেল আমাকে আপু বলে ডাকে, এর পেছনে সংগত কারণ আছে। আমি বয়সে ওর চেয়ে দুই বছর সাত মাস চার দিনের বড়। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, আর হিমেল কলেজে, সেকেন্ড ইয়ার! অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে হিমেল। ওর ইচ্ছে মেডিকেল সায়েন্স পড়বে। মানবদেহের খুঁটিনাটি জানার খুব শখ ওর। এই ধরনের ছেলেরা সাধারণত মনের ব্যাপারে আগ্রহী হয় কম, তবে ও ব্যতিক্রম।
কদিন ধরে হিমেল বলছে, আমাকে একটা কথা বলবে। খুব সিরিয়াস! ‘বলো তো আমাপু, কী বলব তোমাকে?’
আমি অমি। অমির সঙ্গে আপু—ত্রুটিযুক্ত সন্ধি ‘আমাপু’ করে নিয়েছে হিমেল। আমিও মেনে নিয়েছি। কারণ, ছেলেটা বড্ড শার্প আর কিউট! সদ্য কৈশোর পেরোনো নিটোল নিষ্পাপ উচ্ছলতা সারাক্ষণ ছুঁয়ে থাকে ওর সমস্ত শরীর।
পাশাপাশি বাসা। ও প্রায়ই এখানে আসে। কখনো কখনো আত্মীয়ের চেয়ে প্রতিবেশীর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বেশি হয়। সেই অর্থে হিমেলরা আমাদের আত্মীয় ও প্রতিবেশী দুটোই।
সেদিন হঠাৎ হিমেল বলল, ‘অমি, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে। একটু সময় হবে।’ ওর কথা শুনে আমি শুধু চমকালাম বললে ভুল হবে, রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। ভাবলাম, ও বোধহয় ইয়ার্কি মারছে আমার সঙ্গে। ‘আমাপু’র ‘আপু’ নেই, ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’। এ নিশ্চয়ই ইয়ার্কি না হয়ে যায় না!
আমার ভুল ভাঙল একটু পরেই। ওর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা আমাকে বুঝিয়ে দিল, হিমেল মোটেও ইয়ার্কি মারছে না। বরং ও বুঝেশুনে ঠান্ডা মাথায় সব বলছে।
‘হিমেল, আমি না তোর চেয়ে আড়াই বছরের বড়! এভাবে কথা বলছিস কেন?’
‘ওটা কোনো ব্যাপার নয়! ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারের ওয়াইফ অঞ্জলি তার চেয়ে ১০ বছরের বড়। এতে কিছু এসে-যায় না।’ আরোপিত গাম্ভীর্যের স্বরে বলল পুঁচকে হিমেল।
‘এসে-যায় না মানে! কী এসে-যায় না?’ আমি বিপন্ন বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে।
‘যে জন্য তুমি বলেছি! শোনো অমি, আজই আমি কথাটা তোমাকে বলব, বলতেই হবে। তুমি কি শোনার জন্য রেডি?’
‘কী বলবি হিমেল! বন্ধুদের সঙ্গে মিশে আজ তুই উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছিস নাকি!’
ঠোঁটে হাসির প্রলেপ মেখে নিয়ে বললাম আমি। আমার ধারণা, ও আজ হুইস্কিটুইস্কি কিছু একটা খেয়ে এসেছে। নইলে ও এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন। হিমেল বলল, ‘ওসব বদভ্যাস আমার নেই অমি। তুমি দয়া করে আমার কথাটা শোনো। নাউ আই অ্যাম রিয়েলি সিরিয়াস। এক্ষুনি বলে ফেলি। বেশি দেরি করলে পরে হয়তো আর বলা হবে না।’
বারবার ওর ‘অমি’ শব্দটা আমার কানে কেমন খট করে বাজল। আমার পুরো নাম অমিতা। সবাই কষ্ট করে হলেও পুরোটুকু বলে। একমাত্র হিমেল কারসাজি করে ‘তা’ ছেঁটে দিয়ে সন্ধিসহযোগে আপু সেঁটে নিয়েছে। বলাবাহুল্য, শুনতে নেহাত মন্দ লাগেনি। আমি খানিক ঘাবড়ালাম। তবে কি ও কোনো বিপদে পড়েছে? হিমেলের কোনো বড় বোন নেই। আমার ধারণা, হিমেল আমাকে বড় বোনের মতো জানে।
‘ওকে, এবার তাহলে বলি। তুমি কিন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’
‘ঠিক আছে, বল। আমার কান দুটো খোলা আছে।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, অমি। আমি তোমাকে পেতে চাই।’ দুম করে বলে দিল হিমেল। এবার কিন্তু ওর কণ্ঠ একটুও কাঁপল না।
‘হোয়াট! কী বললি তুই পুঁচকে খরগোশ! এসব বিচ্ছিরি কথা কে শিখিয়েছে তোকে। নিশ্চয়ই তোর কোনো ত্যাঁদড় বন্ধু। দাঁড়া, আঙ্কেলকে যদি আজ না বলছি আমি!’ এটুকু বলেই হো হো করে হাসতে লাগলাম। কারণ, হিমেল যা বলল, সেটা হাসি ছাড়া আর কোনো অনুভূতির উদ্রেক করেনি আমার ভেতরে।
‘হেসো না অমি। শুনতে ভালা লাগছে না, কষ্ট হচ্ছে খুব।’ নির্লজ্জের মতো আবার বলল ও।
হিমেল আর দাঁড়ায়নি। কারণ, ততক্ষণে আমার পায়ের চটি উঠে এসেছে হাতে। উদ্বিড়ালের চামড়া দিয়ে বানানো চটি। চটির চটকানি খুব একটা সুখকর হবে না ও বুঝতে পেরেছে। হয়তো সত্যি সত্যি মারতাম না, একটু ভড়কে দিতাম আরকি! এরপর অনেক দিন ও আর এমুখো হয়নি। ভয়ে নাকি লজ্জায়—সেটা হিমেলই ভালো বলতে পারবে। আমিও আর খোঁজ নিইনি। ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা নাকের ডগায়। টিউটরিয়াল নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। পুঁচকে খরগোশের খবর নেব, সময় কোথায়! মাসখানেক বাদে আবার একদিন হিমেল সোজা আমার পড়ার ঘরে ঢুকে বলল, ‘উত্তরটা কিন্তু এখনো দিলে না অমি। আমি তোমার পথ চেয়ে আছি!’ বলেই সোজা দৌড়। পাবলিকের প্যাঁদানি খেয়ে নীতিজ্ঞানহীন নেতারা যেমন দৌড়ায়!
যথারীতি আমি ওর বাবাকে বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছি। চেষ্টা করেছি বোঝাতে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। হিমেল পারলে যেন আমার জীবনটা একেবারে হেল করে ছাড়ে। আমাকে ওর ভালো লাগে। বেশ কথা। লাগতেই পারে। ভাইদের কি বড় বোনকে ভালো লাগতে নেই?
‘না, ও রকম নয়, অন্য রকম।’ আলগোছে ঘাড় নাড়ে হিমেল। তখন ওকে দেখতে ঠিক গরিলার মতো মনে হয়।
‘দেখ হিমেল, এসব কথা আর কাউকে বলিস না। তোকে নির্ঘাত পাগল ভাববে। ভুলে যাসনে, আমি তোর চেয়ে আড়াই বছরের বড়।’
‘বলুকগে! কিচ্ছু এসে-যায় না। আমি তোমাকে বিয়ে করব অমি। কথাটা মনে থাকে যেন!’
আমি ওর কথা শুনে হাসি। পাগল একটা!
হিমেল কথাটা আমাকে আরও কয়েকবার বলেছে। এই বলে শাসিয়েছে, এর অন্যথা কিছু হলে নিজেকে সে শেষ করে দেবে।
‘দ্যাখো হিমেল, পাগলামি কোরো না। জীবনটা তোমার, উল্টাপাল্টা কিছু করলে তুমি নিজেই পস্তাবে।’ বিনে পয়সায় উপদেশ দিয়েছি, কিন্তু ও শোনেনি। মাস্টার্স কমপ্লিট না করতেই মা-বাবা শাঁসালো জামাই পেয়ে আমাকে বিড়াল পার করলেন। আমি পর হয়ে গেলাম। তবে আমি আপত্তি করিনি। ইনফ্যাক্ট আপত্তি করার মতো কোনো কারণও ছিল না। ছেলে দেখতে–শুনতে মন্দ নয়, মাসে মাসে মোটা টাকা মাইনে পায়। অত্যন্ত করিতকর্মা, মেশিনের মতো বিরামহীন নিখুঁত কাজ করে বলে তার এক্সট্রা সুনাম, এক্সট্রা কদর।
বিয়ের পর আমি দূরে চলে গেলাম, তবে শহরের বাইরে নয়। হিমেল আমার বিয়েতে এসেছিল কি না জানি না। খোঁজ নেওয়ার ফুরসত হয়নি। বিয়ের পরও আর দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। আমি মোটামুটি সুখেই আছি বলতে হবে। আমার সুযোগ্য স্বামী অভাব রাখেনি আমার কোনো চাওয়া-পাওয়ার। অপূর্ব সমন্বয় এখানে।
হিমেল আমাকে পায়নি, তবে ও কথা রেখেছে। একটু একটু করে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে নিজেকে। নেশা করে হাজত খাটে।
কিন্তু এখানে আমার কী দায়! অপরের জন্য আত্মসুখ বিসর্জন দেব! আমার কি কোনো দায় ছিল না? দরজায় কলবেল বাজে। ওই তো এসে পড়েছে আমার যন্ত্রায়িত স্বামী। যে আমাকে সবকিছু দিয়েছে, শুধু সুখটুকু ছাড়া!