ওপারে ভালো থেকো তুষার

জুবায়ের কবির তুষারছবি: সংগৃহীত

জন্ম অনিশ্চিত। মৃত্যু অনিবার্য। সে জন্যই হয়তো মানুষ জীবনকে এত ভালোবাসে। স্বর্গের অনন্ত সুখশান্তির কথা শুনেও মরতে চায় না। সীমাহীন কষ্ট নিয়েও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। তুষারও নিশ্চয়ই চেয়েছিল। কিন্তু হার মানতে হলো নিয়তির কাছে। যেকোনো মৃত্যুই বেদনার। মানুষ মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু আকস্মিক অস্বাভাবিক মৃত্যু, যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি থাকে না, যা মর্মান্তিক; তা মানুষকে অন্য রকম কষ্ট দেয়।

আজ অনেক দিনের পুরোনো প্রিয় বন্ধু, অনেক কাছের, ভালো লাগার, ভালোবাসার বন্ধু জুবায়ের কবির তুষারের মৃত্যুতে যে কষ্ট পেলাম, শেষ কবে এত দুঃখ পেয়েছি জানি না। পুরোনো কথাটাই বারবার ফিরে আসে—বেঁচে থাকাটাই মিথ্যে। মৃত্যুই যেন সত্যি। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়, সেই সত্যি যদি মিথ্যা হতো। তুষারদের যখন মৃত্যু হয়, তখন সত্যিটাকে বারবার মিথ্যে ভাবতে ইচ্ছে করে। কতই-বা বয়স ৩০–৩৫ বা আরও কিছু কম বা বেশি! এখনই কি তার চলে যেতে হবে? কেন যেতে হবে? নিয়তির ওপর তো কারও হাত নেই। সৃষ্টিকর্তা যার জন্য যেমন করে ভেবেছেন।

রবীন্দ্রনাথ এক লেখায় বলেছিলেন, ‘এত জনতার ভিড়ে মানুষ তো দেখি না।’ তুষার ছিল সত্যিকারের মানুষ। মানবিক মানুষ। খাঁটি মানুষ। অনেকক্ষণ বিশ্বাস করতে পারিনি যে তুষার নেই। প্রায় দেড় দশক আগে তুষারের সঙ্গে পরিচয়। ও ঠিক কবে প্রথম বন্ধুসভায় এসেছিল, কীভাবে এসেছিল, কী কথা হয়েছিল আজ আর সেসব মনে করতে পারি না। কিন্তু ও যেখানে থাকত, সেখানটা আলোকিত হয়ে যেত। প্রচণ্ড গুণী একজন মানুষ‌। ও কখনো ছোট স্বপ্ন দেখত না। ও জানত ছোট স্বপ্ন একটা অপরাধ।

আমরা একসঙ্গে বন্ধুসভা করতাম। ও বলত, আশফাক ভাই কোনো চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি সব ঠিক হয়ে যেত। তারপর একদিন বিদেশে চলে গেল। বিদেশে গেলে মানুষ বেশি ব্যস্ত থাকে। সাধারণত ভুলে যায়। কিন্তু তুষার ভোলেনি। দেশে থাকতে যতটা মনে করত, এর থেকে বেশি মনে করত বিদেশে থাকেও। দিনে-রাতে, গভীর রাতে কত যে ফোন করেছে, টেক্সট করেছে, এর যেন শেষ নেই।

তুষার সব সময় আনন্দে বাস করত। চারপাশের সবাইকে আনন্দে রাখত। কোনো দিন জানা যায়নি, তার কোনো কষ্ট ছিল কি না। কোনো অভিমান ছিল কি না। হৃদয়যন্ত্রণার ও অভিমানের কোনো ভাষা নেই। আজ তুষার নেই। কিন্তু তার সুন্দর হাসি চির–উদ্ভাসিত মুখ চিরদিন অন্তরে অগোচরে থেকে যাবে।

কোনো ক্ষতি হোক বা না হোক, আমরা বলে থাকি—তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। কিন্তু আজ নিশ্চিত করে মনে হচ্ছে, তুষারের মৃত্যুতে আমাদের অনেক ক্ষতি হলো।

ইংরেজ কবি জন ডানের কবিতায় আছে—
‘যেকোনো মানুষের মৃত্যু আমাকে ছোট করে।
কেননা, আমি মানবতার অংশ।
আর তাই জিজ্ঞেস করো না কার জন্য বাজছে ওই ঘণ্টাধ্বনি
সে বাজছে তোমার জন্য।’
‘যেকোনো মৃত্যুর মধ্যে আমি আমার মৃত্যুর বার্তা শুনতে পাই।’ কবি ও কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন—
চারদিকে জীবনের এত আয়োজন, ব্যস্ততার এত উপকরণ, জীবনের স্বাভাবিকতা এতটাই নির্মম যে আমার প্রিয়জনকে বিস্মৃত হই, বন্ধুদের বিস্মৃত হই—আজ অথবা কাল। তবে আমরা আজ অথবা কাল কোনো দিন তুষারকে ভুলব না…।