আলো ছড়ানো পথে হেঁটে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদফাইল ছবি

শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি উচ্চবিদ্যালয়। পাশ ঘেঁষে চলে গেছে বড় রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে আসা–যাওয়ার পথে শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড়ের শব্দ শুনতে পাই। মাঝেমধ্যে স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মানুষের হাতে অতীতে ফিরে যাওয়ার যন্ত্র বা চাবি থাকলে ভালো হতো। স্কুলের দিনগুলো ফিরে দেখতে পারতাম। স্কুলজীবনের মতো মধুর অধ্যায় আর একটিও নেই।
জানি না, শহরের ওই বিদ্যালয়ের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য আছে কি না। যাতায়াতের দূরত্ব কমাতে এ রাস্তাটি ব্যবহার করি। পায়ে হেঁটে যাতায়াত করার সুবিধা আছে, কিছু চোখে পড়লে সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থাকে। বেশ কিছুদিন ধরে একটি বিষয় নজরে পড়ছে। বিদ্যালয়টির মূল ফটক থেকে কিছুটা দূরে মাঝেমধ্যে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়িটির চারপাশে কাচের দেয়াল। ভেতরে কী আছে বাইরে থেকে দেখা যায়। গাড়ির ভেতরে অনেক বই সাজিয়ে রাখা। টিফিনের বিরতি কিংবা স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা সেখানে একত্র হয়। দায়িত্বরত ব্যক্তির সঙ্গে বই দেওয়া–নেওয়া করে। এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হই। নতুন প্রজন্মের হাতে বই, তারা বই পড়ছে, বই দেওয়া–নেওয়া করছে—এর চেয়ে আনন্দের ও সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে!

একবার এক পরিচিত ভাই বলছিলেন, বর্তমান প্রজন্ম বইবিমুখ হয়ে পড়েছে। এ প্রজন্মকে বইমুখী করতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। জবাবে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে সেদিন শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া–নেওয়ার ঘটনা তাঁকে বলি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির এ উদ্যোগ সম্পর্কে জানাই।
নিজে বই পড়া ও অন্যদের বই পড়তে উৎসাহিত করার উদ্যোগ প্রয়োজন—এ উপলব্ধি আজকের নয়, বহু আগেকার। উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য বইয়ের আলোয় আলোকিত মানুষ প্রয়োজন। এ উপলব্ধি থেকেই ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার শুরু করেছিলেন বই পড়া আন্দোলন। যার ফসল আজকের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জীবন অসংখ্য তারার আলোয় আলোকিত আকাশের মতো বিশাল। কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই জন্ম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন স্যার। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ১৯৬১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন।
দেশ-বিদেশের আনাচকানাচে স্যারের অসংখ্য ছাত্র তাঁর দেওয়া আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন অনবরত। মহাভারতের চরিত্র একলব্য গুরু দ্রোনাচার্যের কাছে সরাসরি ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ না করেও মনের গভীরতা দিয়েই শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তেমনি সরাসরি শিক্ষক না হয়েও স্যার আমার মতো অনেক তরুণের প্রিয় শিক্ষক ও স্বপ্নের মানুষ। তাঁর কথা ও স্বপ্ন আমাদের প্রাণিত করে, স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায়।
ছেলেবেলায় বাবাকে দেখে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হন স্যার। সংকল্প করেন জীবনে কিছু করলে শিক্ষকতাই করবেন। সিলেট মহিলা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ (বর্তমান সরকারি বিজ্ঞান কলেজ), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (পুরকৌশল বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বাংলা পড়াতেন) ও ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। শিক্ষকতার প্রতি গভীর ভালোবাসার জন্যই বিনা সমাদরে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। গৎবাঁধা বইয়ের পাঠ দেওয়ার পরিবর্তে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার শিক্ষার্থীদের চোখে এঁকেছেন বড় জীবনের স্বপ্ন। শুধু জ্ঞান বিতরণের মধ্যেই শিক্ষকতা সীমাবদ্ধ রাখেননি, প্রাণ জাগাতে চেষ্টা করেছেন সব সময়।

কেবল শিক্ষকতা নয়, স্যার যেখানে স্পর্শ করেছেন, সেখানেই ফলেছে সোনার ফসল। ষাটের দশকে যে নতুন ধারার সাহিত্যের আন্দোলন হয়, স্যার ছিলেন নেতৃত্বে। ১৯৬৫ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ছোটকাগজ ‘কণ্ঠস্বর’। ষাট ও সত্তরের দশকের অনেক বিখ্যাত কবি ও লেখকের আত্মপ্রকাশ হয় কণ্ঠস্বরের পাতায়। সম্পাদনার পাশাপাশি কবি ও লেখক হিসেবেও নন্দিত তিনি। মৃত্যুময় চিরহরিৎ, রোদনরূপসী, সংগঠন ও বাঙালি, দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ভালোবাসার সাম্পান ও স্বপ্নের সমান বড় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
জসীমউদ্‌দীনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার মধ্য দিয়ে টেলিভিশনে যাত্রা শুরু করেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। শুরু হয় উপস্থাপক–জীবন। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘সপ্তবর্ণা’ ও ‘চতুরঙ্গ’ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিপুল খ্যতি অর্জন করেন। জনপ্রিয়তার মোহ ত্যাগ করা কঠিন, যে মানুষ তা পারেন, তিনিই অনন্য। স্যার পেরেছিলেন, এখানেই তিনি অসাধারণ। বিশালত্বের মোহ যে এক লহমায় ত্যাগ করা যায়—স্যার শেখালেন। শুরু করলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

‘১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৮। ঢাকা কলেজের পেছনে শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের (এখনকার নাম নায়েম) ছোট্ট মিলনায়নতনটিতে শুরু হলো ছোট্ট পাঠচক্র। সভ্যসংখ্যা মাত্র ১৫। ঠিক হলো প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেকে একটি নির্ধারিত বই এখান থেকে বাড়ি নিয়ে পড়ে পরের সপ্তাহের এই দিনে এখানে এসে মিলিত হবে এক তপ্তমুখর অন্তরঙ্গ আলোচনায়। বইগুলোর ভেতর লেখকদের যে আত্মার আলো জ্বলছে, তার সঙ্গে নিজেদের বহুমুখী বোধের আলো মিশিয়ে তারা জেগে উঠবে উচ্চতর মানবিক সমৃদ্ধির দিকে।’ (তথ্যসূত্র- বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র)
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে ১৯৭৮ সালে মাত্র ১৫ জন সদস্য নিয়ে শুরু হওয়া এ পাঠচক্রটি দেশের নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সারা দেশে এর সদস্যসংখ্যা ২৫ লাখ। বইয়ের আলোয় আলোকিত করতে স্যারের সেদিনের উদ্যোগের ফসলই আজকের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। শূন্য হাতে অল্প অল্প করে স্বপ্নকে পূর্ণ করেছেন, সব পাওয়া না পাওয়ার হিসাব বাদ রেখেই। ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্যারের এ স্লোগান আজ প্রত্যেকের মুখে মুখে। কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো এই স্লোগান জয় করে নিয়েছে মানুষের মন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র স্যারের স্বপ্নের নাম, ভালোবাসার জায়গা। শুধু পাঠচক্র নয়, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, আলোর স্কুল ও পাঠাভ্যাস কর্মসূচির মতো নানামুখী কার্যক্রমে ৪৩ বছরে ১ কোটির বেশি মানুষকে স্পর্শ করেছে স্যারের স্বপ্ন। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসেন নিজের কাজের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার জন্য, অন্যকে পথ দেখানোর জন্য, সমাজে আলো জ্বালার জন্য। স্যার হচ্ছেন আলোর সারথি, যাঁর আলো ছড়ানো পথে হেঁটে যাব আমরা, হেঁটে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
চাঁদ ছোঁয়া যায় না, আবার চাঁদ ছোঁয়া যায়—অনুভবে, ভালোবেসে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্’ তারা তো পারে না জানিতে/ তাহাদের চেয়ে কাছে আছ তুমি আমার হৃদয়খানিতে।’ স্যারকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি কখনো, তবে অনুভব করতে পারি। মনে হয়, স্যারের বিশুদ্ধ হাত আমার মাথার ওপর রাখা এবং তিনি আশীর্বাদ দিয়ে বলছেন, ‘মানুষ হও। স্বপ্ন দ্যাখো, স্বপ্নকে জয় করো।’
সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা