ফেরার আকুতি

অলংকরণ: আরাফাত করিম
বিয়ের পরপরই লেখাপড়া ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে পাড়ি দিল আমেরিকায়। সেখানে তার শ্বশুর-শাশুড়িও দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। সুমনা একেবারে কাঁচা হাতেই গুছিয়ে নিতে চাইল স্বামীর সংসার।

সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারল না সুমনা। থেমে থেমে অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। বহু বছরের জমানো এই অশ্রু। কান্না হয়ে দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অবিরত। কান্নার বৃষ্টি যেন কিছুতেই থামার নয়। ফজরের আজান শুনেই বিছানা ছাড়ল সে। অজু করে নামাজ শেষে পরম করুণাময়ের নিকট দুহাত তুলল। খোদার আরশে জমা রাখল অন্তরের সব জিজ্ঞাসা। দীর্ঘদিনের চেপে রাখা পাহাড়সম বিষাদ আজ যেন ক্ষিপ্রগতিতে নড়েচড়ে উঠল বুকের গহিনে।

সুমনা কিছুতেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছে না। খবরটা পাওয়ার পর থেকে একমুহূর্তের জন্যও নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি। বারবার মমতাময়ী মায়ের মুখখানি চোখে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো ভুল হলো না তো! হয়তো একটা ভুল সংবাদ পেয়েছে। এই পৃথিবীতে তার চিরশান্তির জায়গাটি নিমেষেই চিরতরে হারিয়ে গেল! দুচোখে বিন্দু বিন্দু মমতা নিয়ে তার পথ চেয়ে কেউ আর অপেক্ষার প্রহর গুনবে না। ‘মাগো’ ডাকে ছুটে আসার মানুষটি আর নেই।

রাতে মোবাইলে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অস্ফুট স্বরে নিজেই শুনল মায়ের মৃত্যুর সংবাদ। হতাশায় মুষড়ে পড়া সুমনা করোনার এই সময়ে বাড়ি ফেরার কোনো পথই খুঁজে পেল না। আমেরিকাজুড়ে মৃত্যুর মিছিল। লাশবাহী শত শত অ্যাম্বুলেন্সের করুণ হর্নে বিষাদময় সময় পার করছে দেশটা। এমন দিনে ব্যর্থ হলো বাড়ি ফেরার সব প্রচেষ্টা।

মা-বাবার একমাত্র কন্যা সুমনা। একমাত্র ছোট ভাইটি এ বছর শিক্ষাজীবন শেষ করল। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় মেধাবী মেয়েটির ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবে। স্বপ্ন, বইপুস্তক আর মা-বাবার শত আদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটির বাড়িজুড়ে সুখের কমতি ছিল না। বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিম্ন আয়ে শিক্ষকতা করলেও সমাজে ঢের গ্রহণযোগ্যতা ছিল।

সুমনা তখন সবে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। কী অপূর্ব মায়াময় সৌন্দর্যই না ঢেলে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। এটাই হয়তো কাল হয়েছে তার জন্য। মাঝেমধ্যে খুব ভালো কিছুও যেমন মানুষের জন্য বড় অভিশাপ হয়ে ধরা দেয়। চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আশা শুরু হলো। পথেঘাটে বখাটেদের খারাপ দৃষ্টি চিন্তায় ফেলে দিল মা-বাবাকে। সুমনার অবশ্য এসবে কোনো ধ্যান ছিল না। জীবন নিয়ে অতশত ভাবনা ভাবতে চায়নি সে। সরল চিন্তায় হেসেখেলে বুকের গহিনে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছাগুলো লালন করছিল। কিন্তু ইচ্ছারা ঢালপালা মেলার আগেই হঠাৎ প্রবল ঝড়ে উপড়ে গেল স্বপ্নের চারা গাছগুলো। মানসম্মান হারানোর ভয়ে সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকাপ্রবাসী ছেলে পেয়ে বড় আদরের মেয়েটিকে নিশ্চিন্তে তার হাতে তুলে দিলেন বাবা। বড় আয়োজন ছিল না। ঘরোয়া পরিবেশে সাদামাটাভাবে হয়ে গেল সব। হাজার বার বলতে গিয়েও স্বামীর সিদ্ধান্তের বাইরে একটি কথাও মুখ ফুটে বলতে পারেননি সুমনার মা। বলতে পারেননি সংসারের কিছুই বোঝে না, এমন মেয়েকে এখন বিয়ে দেবেন না।

কেমন বর, কেমন শ্বশুরবাড়ি—এসব নিয়ে মোটেই বিচলিত ছিল না সুমনা। বাবার ওপর সহস্র অভিমানের পাহাড় বুকে নিয়ে নীরবেই মেনে নিল সবকিছু। হাজারো স্বপ্নঘেরা প্রজাপতির পাখার মতো মোহময় চলার পথগুলো কুয়াশায় ঢেকে মুহূর্তেই কেমন ঝাপসা হয়ে গেল। এতটা সহজেই বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে চারপাশের রঙিন ভুবনটা, এর আগে কখনো ভাবেনি সে।

বিয়ের পরপরই লেখাপড়া ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে পাড়ি দিল আমেরিকায়। সেখানে তার শ্বশুর-শাশুড়িও দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। সুমনা একেবারে কাঁচা হাতেই গুছিয়ে নিতে চাইল স্বামীর সংসার। কিন্তু নিয়তি সুবিচার করেনি। ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ১০ বছরের একটি পুত্র আর পাঁচ বছরের একটি কন্যাসন্তান থাকলেও স্বামীর মনে তার জন্য একচিলতে জায়গাও করতে পারেনি।

বিয়ের পরপরই জানতে পারে স্বামী পরনারীতে আসক্ত। সংসারের প্রতি উদাসীনতা দেখে সুমনা আরও নিশ্চিত হলো বিষয়টি। মা-বাবার ওপর রাগে–ক্ষোভে অভিমানী মেয়েটি সব যন্ত্রণা একাই হজম করে চলল। কখনো কাউকে দেখায়নি বুকের মধ্যে অবিরত রক্তক্ষরণের একবিন্দুও। মাঝেমধ্যে মাকে কিছু বলতে গিয়েও কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে কৌশলে। সে চায়নি তার না সইতে পারা বেদনার ভারে স্নেহময়ী জননীও একেবারে নুইয়ে পড়ুক। ১৫ বছরে মাত্র তিনবার সে স্বাদ পেয়েছিল মাতৃক্রোড়ের। নিত্য অবহেলা আর অত্যাচারে স্বামী নামক মানুষটিকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না এখন। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বাসের শেষ বাঁধনটিও ছিঁড়ে গেল সেদিন; যেদিন শুনল স্বামী তার অফিসে কর্মরত এক মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলেছে। দুটো সন্তান জন্মের পর সে আর রাতে তেমন বাসায়ও ফেরে না। তবু সন্তানের মুখপানে চেয়ে দিন কাটাচ্ছে সুমনা। নীরবে–নিভৃতে অশ্রু ঝরিয়েছে কত! মা-বাবা কুশল জিজ্ঞেস করলেই মুখে হাসি ফুটিয়ে সুমনা বলত, ‘আমি ভালো আছি।’

কিছুদিন আগে মায়ের কাছে বেড়াতে গেল যখন; হঠাৎ একদিন মাকে বলেছিল, ‘আচ্ছা মা, মানুষের জীবনে হারানোর তালিকাটা এত লম্বা হয় কেন, বলতে পারো? প্রিয় শৈশব হারাল, হারিয়ে গেল খেলার সঙ্গীরা, স্বজনদের সুবাসমাখা প্রাণের বাসভূম, প্রাণের বিদ্যাপীঠে সহপাঠীদের হইহুল্লোড়ের আনন্দমুখর ক্যাম্পাস, কোথায় হারাল মমতাময়ী মায়ের সেই স্নিগ্ধ শাড়ির আঁচল। তোমরাও কি একদিন হারিয়ে যাবে আমার জীবন থেকে? বলে রাখলাম, সেদিন আমিও আর বেঁচে থাকব না মা। রংধনুর সাত রঙের আবিরমাখা সেই সোনালি দিনগুলো হঠাৎ কেমন করে সময়ের কালো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল। না ফেরা রংধনুকাল আর কখনো কি ফিরে আসবে না মা?’

ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধটা আর চালিয়ে যেতে পারছে না সুমনা। স্বামীর দেওয়া শত অবহেলা সইতে পারলেও তার দ্বিতীয় বিয়ের কারণ খুঁজে পেল না। সেই ধাক্কাটা প্রবল গতিতে বুকের ভেতরটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পার করে সুমনা সিদ্ধান্ত নিল, স্বামীর সংসার আর করবে না। বড় ছেলেটাকে দাদা-দাদির কাছে রেখে ছোট মেয়েটাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে ফিরে আসতে চাইছে। মনের কথাটি মাকে জানাতে, গেল সপ্তাহে বাড়িতে ফোন করতেই জানতে পারল মায়ের অসুস্থতার কথা। শত চেষ্টা করেও মাকে আর বলতে পারল না, তাঁদের কন্যা বাড়ি ফিরে আসতে চায়। তবু মনে আশা বেঁধে রেখেছে। সুস্থ হলেই সবকিছু জানিয়ে দেবে মাকে।

মায়ের মৃত্যু সংবাদে কালবৈশাখী ঝড়ে বিধ্বস্ত, নীড়হারা বাবুই পাখির মতোই ছটফটাচ্ছে সুমনা। বুকের মধ্যে শুরু হলো সর্বগ্রাসী আর্তনাদের উথালপাতাল ঢেউ। বহু কষ্টে দমিয়ে রাখা বেদনার প্লাবন আজ আর বাঁধ মানল না। কাবোষ্ণ জলের ভাষায় আজ সুমনা রচনা করছে বেদনার মহাকাব্য। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে যখনই সে প্রস্তুতি নিয়েছে মায়ের বন্দরে ফেরার, সেই মুহূর্তে আরেক অজানা গন্তব্যে চিরতরে চলে গেলেন মা। এই পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই মাকে আর খুঁজে পাবে না। মাকে আর জানানো হলো না নীড়ে ফেরার গোপন আকুতি। গন্তব্য যেখানেই হোক, সুমনা তবু ফিরে যেতে চায় মায়ের নিশ্চিন্ত বুকে। কোলে শুয়ে একজনমের গল্পটা বলতে চায়। বলতে চায় তার ভালো না থাকার গল্পটাও।

সহকারী শিক্ষক, দক্ষিণ পশ্চিম চরফকিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী