একটা সময় ছিল, শিক্ষকতায় তাঁরাই আসতেন, যাঁদের এই পেশায় কাজ করার প্রকৃত ইচ্ছা থাকত। সমাজের দরিদ্রতা তাঁদের গ্রাস করতে চাইলেও, প্রাপ্ত সম্মান দরিদ্রতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁদের মুখে হাসি এনে দিত। পরিবারের চাহিদা মেটাতে চাকরি করলেও অর্থলোভী ছিলেন না কখনো। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেওয়া ছিল তাঁদের প্রধান ব্রত। শিক্ষার্থী বেয়াদবি বা পড়ায় অমনোযোগী হলে শিক্ষকেরা বুঝিয়ে বলতেন, কখনো বকা দিতেন, কোনো কিছুতে কাজ না হলে বেত্রাঘাত করতেন। তবু ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল মধুর। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অনুকরণ করত, তাঁদের যোগ্য সম্মান এবং শাস্তি দিলে তা মাথা পেতে মেনে নিত।
পড়া না পারলে বিশেষ করে যদি কখনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা হতো যেমন ক্লাস ফাঁকি, চুল বড় রাখা, ড্রেস ঠিক না থাকা, ক্লাসে কাউকে তিরস্কার বা মারামারি করা, তখন শিক্ষকেরা বুঝিয়ে বলতেন অথবা বেত্রাঘাত ছিল অন্যতম মহৎ ওষুধ। কারণ, কিশোর বয়সের দুরন্ত মন নিজের বিবেকে পরিচালিত হয় না। শিক্ষকের ভয়ে আমরা ক্লাসে নীরব থাকতাম, নিজেদের মধ্যে মারামারি হলে মিটিয়ে নিতাম, শিক্ষকের কানে যাতে না পৌঁছায়, তার জন্য কত রকম পন্থা অবলম্বন করতাম। শিক্ষক মারামারির শাস্তি সবাইকে দিতেন। কখনো কখনো শরীরে দাগ নিয়ে বাড়ি যেতে হতো। সম্মান দেখানোর জন্য চলন্ত সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নেমে যেতাম শিক্ষকদের দেখলে। একবার স্কুলের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রধান অতিথি হিসেবে এসে আমাদের একজন প্রবীণ শিক্ষকের পায়ে ধরে সালাম করলেন এবং প্রধান অতিথির আসনে শিক্ষককে বসিয়ে নিজে সাধারণ চেয়ারে বসলেন। তিনি ওই শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকদের সামনে তাঁর আচরণে কখনো মনে হয়নি তিনি নিজেও সম্মানিত ও ক্ষমতাসীন কেউ।
কিন্তু বর্তমানে শিশুর মানবিক বিকাশ ঘটানোর জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়, যা অবশ্যই উচিত নয়। সেটা ভূত–প্রেতাত্মার, পশুপাখি, মানুষ কিংবা বেত যা–ই হোক না কেন। আর যদি একজন শিক্ষার্থীকে বারবার বলার পরও সে পরিবর্তন না হয়, তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। তবে সেটা যেন সহনশীল হয়। এখন অনেক শিক্ষককে বলতে শোনা যায়, শিক্ষক হওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না, নেহাত চাকরি পাচ্ছেন না বলে যোগদান করেছেন। কেউ আবার ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে বাইরে টিউশনিতে সময় দিচ্ছেন। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা হচ্ছে ক্লাসবিমুখ আর শিক্ষকেরা হারাচ্ছেন তাঁদের সম্মান। আগের শিক্ষকদের মতো তাঁদের আর্থিক সমস্যা নেই, আছে সম্মানের ঘাটতি। আর যাঁরা এখনো শিক্ষকতা পেশায় নিজেদের আদর্শ বজায় রেখেছেন, তাঁদের সৎভাবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষকেরাই এখন শিক্ষার্থীদের তিরস্কার ও আঘাতের শিকার হন। শিক্ষার্থীর আঘাতে শিক্ষকের মৃত্যু, জুতার মালা গলায় নিয়ে পুলিশের সামনে গাড়িতে উঠানো, রাজনৈতিক নেতার কাছে শিক্ষকের লাঞ্ছনা—এসব ঘটনা এখন মাঝেমধ্যেই খবরের শিরোনামে দেখি। দেশে কিশোর অপরাধ আশঙ্কাজনক বাড়ছে। এটা আরও বাড়বে। কারণ, শিক্ষকের চেয়ে এখন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ক্ষমতা বেশি। শিক্ষকদের দাসে পরিণত করা হচ্ছে, এতে অনেকটা দায় সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। শিক্ষকদের যোগ্য সম্মান না দিলে সমাজের এ অধঃপতন কখনো বন্ধ হবে না।
বিপরীত চিত্রও আছে। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগও আসছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষক সমাজের জন্য এটা খুবই লজ্জাজনক। শিক্ষকেরা পিতা-মাতার সমতুল্য। সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তাঁদের আরও দায়িত্ববান হতে হবে। শিক্ষকদের যদি মূল্যবোধ না থাকে, তাঁরা শিক্ষার্থীদের কী শেখাবেন? দেশের উন্নয়ন, শিক্ষার মান তথা শিক্ষার্থীদের মানবিক, সময়ানুবর্তী, শ্রদ্ধাবোধ শেখাতে হলে শিক্ষকদের সেই মানের হতে হবে।
সাধারণ সম্পাদক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা