ভায়োলিনে মেলানকলি

ভায়োলিনে মেলানকলি
কষ্ট কি নিতান্তই ধ্রুব? কেন তা কমে না কিংবা বাড়ে না। ভায়োলিনের অপার্থিব করুণ সুর কেন কষ্টকে বাড়িয়ে দিচ্ছে না। আমি আরও দুঃখী হতে চাই।

‘সেই সব নিহিলিস্টদের জন্য যারা আজও জীবনের মানে খুঁজে পেল না’

শ্রাবণের দ্বিতীয় দিন, রাত ২টা।
যে জন্য সবকিছু ফেলে এখানে আসা সেটা ব্যতীত সবকিছুই উপস্থিত। না রেখেছি কোনো যোগাযোগের মাধ্যম; না রেখেছি প্রযুক্তির পিছুটান। বাড়িতে বলে পর্যন্ত আসেনি আমি কোথায় যাচ্ছি। জীবনকে একটু গভীরভাবে বুঝতে, মূল কথা মানুষের সুখ আসলে কী? সেই উত্তরটা খুঁজতে আমার এই অতি একা ভ্রমণ। সংজ্ঞাহীন এক মনের অসুখ একটু কম করতে এসেছি এই পাহাড়ের দেশে। কিন্তু তা কমে কই? বিশাল পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি হয়ে যেন তা দ্বিগুণ হয়ে আছড়ে পড়ে। দার্শনিক থোরু গিয়েছিলেন বনবাসে। জীবনের গভীর দর্শন বুঝতে; প্রকৃত সুখী হতে। তা পেরেছিল কি? আমার পরিণতিও সেই দিকে এগোবে, তা বোঝা কঠিন নয়।

এখানে আমার সঙ্গী বলতে একটি ভায়োলিন আর কিছু কাগজ। সকাল থেকে ভায়োলিনের নতুন নোট বানানোর চেষ্টা। ব্যর্থ নোটে ভর্তি হলো কাগজ; ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল পরম অবহেলায়। যে অল্প কিছু মিলেছে, তা এতই অদ্ভুতশ্রাব্য যে কোনো মিউজিকবোদ্ধা তা শুনলে যারপরনাই বিস্মিত হবে। ভায়োলিন নিয়েই আমার সবকিছু। জীবনের যদি কোনো জ্বালানি থাকত, আমার ক্ষেত্রে তা হতো ভায়োলিন। আর তাতে কিনা আমি বাজখাই আওয়াজ বের করছি। সংগীতের ভাষায় যাকে বলে মিউজিশিয়ানস ব্লক। অস্থিরতা আর বিষাদ একসময় এতই তীব্র হলো যে মরফিন ডোজ নিতে বাধ্য হলাম।

এর পরের ঘটনার স্মৃতিটি আজও আমার বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়ে চলেছে। মরফিনের ডোজে তখন আমি ঝাপসা দেখছি। হালকা হয়ে যাচ্ছে শ্বাস। অত্যন্ত ভারহীনতাই আমার দেহ ভাসছে যেন। আমার কানে একটা ভায়োলিনের নোট ভেসে এল। আমি ভালো করে শুনলাম। তারপর দেহের সব নিউরণগুলো যেন সেই রিদমে আন্দোলিত হয়ে উঠল। এত সুন্দর ভায়োলিন কখনো শুনিনি। জানি না আমি হেঁটে বাইরে গিয়েছিলাম কি না। কারণ, তারপর আমি আমার দেহের ভর আর অনুভব করিনি। পালকের মতো নীরব আর ধীরে ভাসতে লাগলাম। ঘরের বাইরে বেরিয়ে প্রথম দেখলাম পূর্ণিমার চাঁদটি। শুভ্র মৃত্যু দ্যূত যেন আমারই মৃত্যুর অপেক্ষায় মূর্তিমান। আমার কোনো আক্ষেপ নেই তাতে। কারণ মনে হলো তখন আমি এমনিই মৃত। ভায়োলিনের রিদমে হয়তো আমার আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। দেহকে সঙ্গে নেওয়ার সময় তার হয়নি। কে এই বাদক? জান্নাতের কোনো ফেরেশতা? না কোনো ছলনাময়ী শয়তান?

অবশেষে পেলাম তাকে। আমার ভবনের সামনে রাস্তা, ওপাশে খাদ। খাদের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে এক ধবল নারী। তার চুলগুলো সোনার মতো, বাতাসে উড়ছিল আর মাদল ঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল। তার পিঠে কবুতরের মতো একটা শ্বেত ডানা। ডানার আড়ালে হাতে ধরা একটা ভায়োলিন। গায়ে সাদা রঙের গাউনমতো পোশাক। সবকিছু মিলিয়ে যেন চাঁদের নিচে আরও একটা চাঁদ। তার মাথায় চুলের সঙ্গে মিশে আছে একটা সোনার কেশবন্ধনী। অনেক কাছে চলে গেলাম। অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো। আমি তখন ভয়ের ঊর্ধ্বে। শুধুই তার ভায়োলিনে একটু একটু করে ভেঙে স্মিত বাতাসে উড়ে যাচ্ছিলাম।

কষ্ট কি নিতান্তই ধ্রুব? কেন তা কমে না কিংবা বাড়ে না। ভায়োলিনের অপার্থিব করুণ সুর কেন কষ্টকে বাড়িয়ে দিচ্ছে না। আমি আরও দুঃখী হতে চাই। বিষাদ আরও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরুক। তাহলে হয়তো আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম সেই মুহূর্তটাকে। কেন কষ্টের বিপরীত কোথাও নেই আমার। পদার্থবিদ্যার মতে সবকিছুরই বিপরীত ক্রিয়া থাকে। মনোবিজ্ঞানেও কি একই কথা প্রযোজ্য? তাই যদি হতো, তাহলে সেই সময় আমি হতাম পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ। ওরকম সুখী কেউ কোনো দিন হতে পারেনি। চাঁদের যে অংশ আমরা দেখি না, সেখানে কোথাও লুকিয়ে থাকে দুঃখ। যে দুঃখ চাঁদকে এত সুন্দর বানিয়েছে। সুখ আপেক্ষিক, কিন্তু দুঃখ না। এই প্রবল অর্থহীনতার মধ্যেও ভায়োলিন, চাঁদের আলো, বাতাস কেন এত অর্থবহ হয়ে ওঠে।

সবকিছুরই শেষ আছে। আমাকে অবশিষ্ট না রেখে অবশেষে ভায়োলিন থামল। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল নারী মূর্তিটি। জানি সে পৃথিবীর কেউ না। তাকে দেখে আত্মার যেটুকু অংশ বাকি ছিল তা-ও ঋণাত্মক হলো। মনে হলো তাকে ছাড়া এ ঋণাত্মকতা শেষ হবে না। অপলক তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সেই চেহারা বর্ণনার অতীত। তার উপযোগী ভাষা এখনো সৃষ্টি হয়নি। তার গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটো যেন আমাকে মেরে ফেলার জন্যই মৃদু হেসে উঠল। মেরে ফেলার মতো নিষ্ঠুর সে হতে পারেনি। ডানা মেলে উড়ে পালাল অভৌতিক এক ঘ্রাণ ছড়িয়ে।

পরে খুবই চেষ্টা করেছি সেই ছোনাটা আমার ভায়োলিনে প্লে করতে। সম্পূর্ণ পারিনি, যা পেরেছি মনে হয় ১০ শতাংশ হবে। হয়তো আমাদের পৃথিবীর ভায়োলিন ওরকম রিদমে চলে না। কিছু কিছু নোট শুধুই কল্পনা করতে পেরেছি। বাস্তব জগতের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব না। আমার মনে হয় মানুষদের তা শোনা উচিত নয়। শুনলে হয়তো কেউ কেউ পাগল হয়ে যেতে পারে। জি মাইনরে কম্পোজ করেছি মিউজিকটি। আমি এই ছোনাটা প্রকাশ করেছি পরে ‘ডেভিলস ট্রিল ছোনাটা’ নাম দিয়ে।

ডেভিল কেন? কারণ, ও উড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরে নিরাক পড়া নীরবতা নেমে গিয়েছিল সবখানে, পূর্ণিমার চাঁদটিও মেঘের আড়ালে লুকাল। ভায়োলিন বাজানো থামাল সে, সবকিছুই আবার অর্থহীন। বন্য একাকিত্ব জড়িয়ে ধরল আমাকে, প্রাচীনতম এক মানুষ মনে হলো নিজেকে। যেন অপেক্ষা করে যাবে সে অনন্তকাল। আমার দুঃখ পুকুরে পুলকের যে ঢিলটি ছুড়ে মেরেছিল সে তাতে বিষণ্ন শেওলা সরে গিয়ে চাঁদের আলো ঢুকেছিল। সে হারালে শেওলা আবার ঢেকে দিল আত্মাকে। তার পর থেকে আমি অনন্ত তিমিরে।

পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা