নায়িকা কবরীর ঘটনাবহুল জীবনী নিয়ে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘কবরী’

‘কবরী’ উপন্যাস

সিনেমাজগতের নায়িকার জীবনী নিয়ে এটাই সম্ভবত প্রথম উপন্যাস। চিত্রনায়িকা কবরীকে নিয়ে বিশ্বজিৎ চৌধুরী ‘কবরী’ লিখেছেন ২০২৫–এর অমর একুশে বইমেলায়। লেখকের ‘নার্গিস’ বইটি পড়ে যেমন বিমোহিত হয়েছি, তেমনি ‘কবরী’ পড়ে আরও বেশি বিমোহিত হয়েছি। একটা ঘোর লাগা কাজ করছে, বইটি পড়ে শেষ করার পর। চট্টগ্রামের পাথরঘাটার নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা কিংবা পরিবারের সচ্ছলতার কথা ভেবে সিনেমার জন্য ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী পাড়ি জমিয়েছিল ঢাকায়। এরপর সাড়ে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে। প্রথম ছবিতেই বাজিমাতসহ নায়িকার জীবনের আলো-অন্ধকার জগৎকে বেশ চমকপ্রদভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। বইটিতে কী আছে তা জেনে নেওয়া যাক। তবে নায়িকা সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা জানতে বইটি পড়তে হবে একান্ত নিমগ্নে।

১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের জে এম সেন স্কুলের ক্লাস এইটে পড়া মিনা পাল নামের এক কিশোরীর প্রথম ছবি বের হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে হইচই পড়ে গেল। তখনকার সিনেমাবিষয়ক পত্রিকায় বের হলো বিরাট শিরোনাম—‘আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম’। বলছিলাম ১৩ বছর বয়সে বাঙালি দর্শকদের স্বপ্নের নায়িকা বনে যাওয়া কবরীর কথা। কবরীর প্রথম ছবি ‘সুতরাং’-এর প্রযোজক ছিলেন চিত্ত চৌধুরী। বয়স চল্লিশের বেশি।

ক্লাস এইটে পড়াকালীন ডাক্তার অসীম নন্দীর প্রেমে পড়েছিলেন কবরী। যাঁর কথা ভাবলেই কবরীর মনে পড়ত সেই বিখ্যাত গান—‘ওই চোখে সাগরের নীল...’। কিন্তু...

‘যে জীবন পাই নাই তার জন্য আফসোস একটু আছে, তবে যে জীবনটা কাটালাম তার জন্যও কোনো রিগ্রেট নেই।’ কবরীর এই আক্ষেপ কি তাঁর পারিবারিক সচ্ছলতার জন্য! ক্লাস এইটে পড়াকালীন ডাক্তার অসীম নন্দীর প্রেমে পড়েছিলেন কবরী। যাঁর কথা ভাবলেই কবরীর মনে পড়ত সেই বিখ্যাত গান—‘ওই চোখে সাগরের নীল...’। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল বয়সে ৩০-৩৫ বছরের বড় প্রযোজক চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে। কবরীর বাবা কৃষ্ণদাশ পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিংবা সিনেমা লাইনে একজন অভিভাবকের কথা চিন্তা করেই হয়তো এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন আগে দুই বিয়ে করা প্রযোজকের সঙ্গে।

‘বাহানা’ ছবির পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। সেই সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে সখ্য গড়ে ওঠে বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে। জহির রায়হানের আবেগ বেড়ে ওঠে সাড়ে ১৪ বছর বয়সী উঠতি নায়িকা কবরীর সঙ্গে। অথচ জহির রায়হান বিবাহিত। বিয়ে করেছেন দুই বাচ্চাসহ বন্ধুর বউকে। এরপরও কবরী জহির রায়হানের কোথায় যেন কোথায় যেন!

নায়িকা চেয়েছিলেন একটা সুখের জীবন কাটাবেন সঙ্গিনীর সঙ্গে। কিন্তু চিত্ত চৌধুরী কবরীর গায়ে হাতও তুলতেন। ‘বাহানা’ ছবির শুটিংয়ের শেষ দিন কবরীকে জহির রায়হান আবদার করে বলেছিলেন, আবারও করাচির হাক্সবে সমুদ্রসৈকতে যেতে চান, একা দুজনে!

অনিষ্ঠ সাংসারিক জীবনকে পেছনে ফেলে জহির রায়হানের হাত ধরে কবরী পাড়ি দেন করাচি। দেশে জানাজানি হলে কাবিননামাও করে ফেলেন খুব অল্প সময়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চিত্ত চৌধুরী কবরীকে ফিরিয়ে আনেন দেশে। কিছুদিন পর জহির রায়হান চট্টগ্রাম কোর্টে মামলা করেন, তাঁর সদ্য স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার আকুলতায়। আদালত চত্বরে পৌঁছে দেখা যায়, কবরী আসছেন শুনে প্রচুর ভক্তের ভিড়। ভক্তদের ভিড়ে যে রুমে মামলা বসার কথা ছিল, সেখানে হয়নি। ভক্তরা একনজর সশরীরে কবরীকে দেখতে চান। স্বপ্নের নায়িকাকে সামনে থেকে দেখার আনন্দ কে মিস করতে চান! কবরী এই বাঁধভাঙা মানুষের জোয়ার খুব উপভোগ করছিলেন, আবার কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল তাঁর ব্যক্তিজীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়াদি নিয়ে।

বিচায় নয়, আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে বলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইনাম আহমেদ চৌধুরী। মামলার প্রসেস দীর্ঘস্থায়ী।

কবরী থাকতে চান চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে! এক দ্বিধাগ্রস্ত জীবন। পরিবার, সমাজের কথা চিন্তা করে ইনাম আহমেদ চৌধুরীর এক প্রশ্নের জবাবে মামলা ওখানেই থেমে গেল। এই প্রথম তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কবরী কার সঙ্গে থাকতে চান!’ দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের পকেটে ছিল কাবিননামা। এই কাবিননামার কি তখন মূল্য আছে?

আসলে দুঃখ, হতাশা শব্দগুলো বোধ হয় দুর্বলেরাই আগলে রাখে দীর্ঘকাল। সবল জীবনবাদী মানুষ ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়ায় ফিনিক্স পাখির মতো। জহির রায়হানও দাঁড়িয়েছিলেন।

‘বেহুলা’ সিনেমা বানাতে গিয়ে জহির রায়হান প্রেমে পড়েন নায়িকা সুচন্দার। এরপর বিয়ে! তারপর ‘লেট দেয়ার বি লাইটে’ নায়িকা অলিভিয়ার প্রেমেও পড়েছিলেন, এমন কথাও ওঠে জহির রায়হানকে নিয়ে। পরে বনিবনা না হওয়ায় ববিতাকে কাস্ট করা হয় সিনেমায়। কী এক প্রেমিক জীবন কাটিয়েছিলেন জহির রায়হান। যার শেষ ১৯৭১ সালে জহির রায়হানের হারিয়ে যাওয়া দিয়ে শেষ হয়। বড় ভাইকে খুঁজতে বের হয়ে জহির রায়হান হারিয়ে যান। বেঁচে থাকলে হয়তো আরও কালজয়ী সাহিত্য ও সিনেমা উপহার পেত বাংলাদেশ।

ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন কবরী। কারও সঙ্গে যোগাযোগ বা আড্ডা একেবারেই বন্ধ।
১৯৬৮ সাল। চিত্ত চৌধুরীর ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ভাবলেন, কবরী যদি আবারও অভিনয় করেন, তাঁর হাতে টাকা আসবে। কবরীও সুযোগের অপেক্ষায়, কখন চিত্ত চৌধুরীর কারাগার থেকে বের হয়ে একটু মুক্তভাবে চলতে পারবেন। সে বছর ‘সাত ভাই চম্পা’সহ বেশ কিছু মুভি হিট। নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে জুটিটাও বেশ জমে ওঠে। হয়তো একান্ত সঙ্গোপনে প্রেমে পড়েছিলেন নায়ক রাজ্জাকের। সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য অন্ধ ভিখারি ছিলেন কবরী। কিন্তু তিনি সত্যিকারের ভালোবাসাটা কি পেয়েছিলেন?

প্রতিটি হলে কবরীর সিনেমা চলছে, তখন সিনেমাপাগল মানুষের মনের রানি কবরী। অথচ নিজ ঘরেই প্রাপ্য সম্মানটুকু পাচ্ছেন না। সে জন্যই বোধ হয় সিনেমার শুটিং শেষে মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যেতেন নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে। আবার কখনো-বা ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) মাস্তান আজমল হুদা মিঠুর সঙ্গে। আইয়ুব খানের পোষা বাহিনী ছিল এনএসএফ। সরকারি মদদে আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলা করাই ছিল তাদের মূল অ্যাকটিভিটি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কবরী ভারতে যান সীমান্ত পেরিয়ে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চললেও শিল্পজগতের মানুষ কবরী সেখানে আরেক যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। শরণার্থীশিবিরে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়া ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ। কারণ, মানুষ কবরীকে চিনত এবং তাঁর কথার মূল্য দিত।

যুদ্ধ শেষে এফডিসিতেও তেমন জমজমাট ভাব লক্ষ করা গেল না। এর মধ্যে জনপ্রিয় জুটি রাজ্জাক-কবরীর জুটিটাও ভেঙে যায়, ছোট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবরীর ঔদ্ধত্য আচরণে। এ ঘটনার রেশ প্রায় ২০ বছর ছিল। ২০ বছর পর তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মা–বাবার চরিত্রে। অথচ দর্শকেরা চেয়েছিলেন প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি।

চিত্তবাবুর মেন্টাল-ফিজিক্যাল টর্চার থামছেই না। যুদ্ধের পর দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়। এ সময়ে কবরীর পরিচয় হয় ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া শামসুজ্জোহার ছেলে শফিউদ্দিন সারোয়ারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কবরী সংসার করেছিলেন প্রায় ৩০ বছর। সে সময় কবরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, শুধু সারোয়ারের সঙ্গে ঘর করবেন বলে। ভালোবাসার কাঙাল কবরী একটা শক্ত হাত ধরতে চেয়েছিলেন। বোধ হয় সেটা পেলেনও। এই রাজনৈতিক পরিবারের হাত ধরেই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন পান। অবশ্য শামীম ওসমান দেশে থাকলে হয়তো অন্য কিছু ঘটতে পারত তখন।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্ররোচনায় শেখ হাসিনা তখন নারায়ণগঞ্জ আসনে কবরীকে নমিনেশন দেন। শামীম ওসমান তখন তাঁর চাচি কবরীকে নিষেধ করেন এবং এর জের ধরেই কবরীকে তালাকনামা পাঠান সারোয়ার। কবরীর যে জেদ, সে জেদ ধরেই তিনি ইলেকশন করেন। সেবার শামীম ওসমান নমিনেশন পাননি, ওয়ান–ইলেভেনের সরকার থাকায়। দেশে থাকলে তাঁকে হয়তো জেলের ঘানি টানতে হতো।

এমপি থাকা অবস্থায় একবার চট্টগ্রামে ফতেয়াবাদে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন কবরী। সেখানে দেখা হয় তাঁর প্রথম ভালোবাসার মানুষ অসীম নন্দীর সঙ্গে। লোকটা বেশ অসুস্থ। দেখা হওয়ার কিছুদিন পরেই অসীম নন্দী পরলোকগমন করেন। কী অদ্ভুত ঘটনা। হয়তো জীবনের শেষ সময়ে, কবরীর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন অসীম নন্দী।

জীবন বড়ই অদ্ভুত। ২০০০ সালে নায়িকার কিডনিতে পাথর জমে, পরে মুম্বাইয়ে গিয়ে একটা কিডনি ফেলে দিতে হলো। এক কিডনি নিয়ে বেঁচে ছিলেন ১৭ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত। কাজের প্রতি উদ্যম ছিল, করোনার সময়ও সিনেমা তৈরির কাজ থামাননি।

এক জীবনে অসংখ্য আক্ষেপ নিয়ে কবরী করোনার থাবায় হারিয়ে গেলেন এই পৃথিবী থেকে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মুদ্রিত মূল্য ৫০০ টাকা।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা