দ্বিচক্রযান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কিছু ক্ষেত্রে ভূমিকা বা উপক্রমণিকার প্রয়োজন আছে বৈকি। জীবনকে নিয়ে নানা রকমের বিপত্তি নতুন কিছু নয়; আবার জীবনের মহিমারও তো শেষ নেই। জীবনে কখনো একজন মানুষ পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে, আবার কখনো একাধিক বা ততোধিক মানুষ এসে কড়া নাড়ে!

ঘটনাচক্রে গণশার বিধবা মা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বসে আছে। বিষয়টা তেমন কানাকানি হয়নি এখনো। গণশার মা ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না যে ওই সময়টাতে মদনার বাপ এল না গণশার ধর্মবাপ! নির্দিষ্ট করে কাউকে দায়ী করাও বেশ কঠিন। অনেকটা সাহস করে গণশার ধর্মবাপকে ইঙ্গিতে কিছুটা বোঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে রীতিমতো অস্বীকার করে হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

গণশার মা কাঁদতে কাঁদতে বাথরুম সেরে মদনার বাপকে মুঠোফোনে বিষয়টা জানাল। মদনার বাপ তখন মাতাল অবস্থায় ছিল। কোনো কিছু না বুঝেই বলল, ‘তোকে এবার বিয়ে করার সুযোগ এসে গেল! ওটা কার হয় হোক, আমাকেই তো বাপ বলবে নাকি?’ কত জটিল সমস্যার সহজ সমাধান!

মদনার বাপকে বিয়ে করা গণশার মায়ের পক্ষে অসম্ভব নানা কারণে। সে মদ্যপ, অশিক্ষিত। তা ছাড়া মদনার মাকে রোজদিন মারপিট করে, হিতাহিত জ্ঞান বলতে তার কিছুই নেই। অন্যদিকে গণশার ধর্মবাপের যোগ্যতা ভালো। বাসের শ্রমিক, বউটাও মারা গেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝামেলামুক্ত একটা মানুষ।

গণশার মা গণশার ধর্মবাপের ওপরই চাপাতে চায়। কিন্তু সে বিষয়টি এড়িয়ে চলছে। কখনো আশা দেয় আবার কখনো উল্টাপাল্টা কথা বলে। খুব বিপদে গণশার মা। পেটের ভ্রূণটা মাঝেমধ্যেই নড়চাড়া করে, একটা খুশির ঝলক চোখেমুখে ভেসে ওঠে তখন। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের। গণশাটা না থাকলে আত্মহত্যাই করত গণশার মা। বাঁচা-মরার লড়াইয়ে তার দ্বিচক্রযান বর্তমানে সম্পূর্ণ অকেজো। তবু বাঁচার প্রত্যাশায় মরতে মরতেও মহিলাটা কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যায়।

হঠাৎ সেদিন দুপুরে মদনার বাপ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল গণশার মায়ের ওপর। ঘণ্টা দেড়েক পরে ফ্রেশ হয়ে বলল, ‘চল আজকেই শ্যামরাই মন্দিরে তোকে বিয়ে করব।’ স্নান করে রেডি হতে বলল। গণশা ওর দিদার সঙ্গে পরীক্ষা শেষে দাদুর বাড়িতে। শরীরে ব্যথা নিয়ে মন্দিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত গণশার মা। বাইরে সুবাসের অটোরিকশা রেডি।
বের হতেই দরজায় গণশার ধর্মবাপ কঠিন চোখে গণশার মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’ গণশার মা জবাব না দিয়ে পাশ কেটে মদনার বাপের পিছু পিছু বের হয়ে গেল অনেকটা অহংকারী ভঙ্গিমায়। গণশার বাপ এলোমেলো এসবের কিছুই বুঝতে না পেরে ওখানেই বসে পড়ল এবং হেমন্তের শুরুতে উত্তরের দিকে চেয়ে থাকল; যেন অস্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনারং রোদ্দুর গায়ে মেখে পরিবর্তিত সময়ের অপেক্ষা।

রাজবাটি, দিনাজপুর