বক ও মাছরাঙার বন্ধুত্ব

বক ও মাছরাঙার মিতালি। ছবিটি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নতুন বসতি গ্রাম থেকে তোলাছবি: আব্দুল মোমিন

ঝিকরগাছা বিলে বক ও মাছরাঙার প্রথম দেখা হয়। দুজনে নানা ধরনের গল্প করে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। যখন যেখানে যায় একসঙ্গে। বক মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ফসলের মাঠে গিয়ে পোকামাকড় খায়। মাছরাঙাও খায়। তার এখন এসব আনন্দের। সময় হাসিখুশিতে যাচ্ছে। বেশ কয়েক দিন ধরে বক পোকামাকড় খায় না। শুধু মাছ ধরে খায়। মাছ তার প্রিয় খাবার। পোকামাকড়ের আর প্রয়োজন হয় না। এদিকে মাছরাঙা পুকুরে, ডোবা–নালায় মাছ ও জলজ পোকা খোঁজ করে। বকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর তারও আর পুকুরের মাছের প্রতি টান হয় না। বক যেখানে যায়, মাছরাঙাও সঙ্গে উড়ে যায়। বকের সঙ্গে গান গায়, খেলে ও পাখা মেলে আকাশে ওড়ে। কোথাও যেন তাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
দূরদূরান্তে ছুটে চলা ও মাছ সন্ধান করা তাদের নিত্যদিনের কাজ।

একদিন বক ও মাছরাঙা উড়ে এসে গাছের ডালে বসে। নতুন একটি পুকুর আবিষ্কার করে। এখানে আগে কত এসেছে, কিন্তু পুকুরটি চোখে পড়েনি। অনেক বড় পুকুর, ঠিক বিলের মতো। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আশপাশে অনেক গাছ পুকুরের চারদিকে ঘেরা। নান্দনিকতায় ভরপুর প্রকৃতি। এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করছে তাদের।
ঝুম বৃষ্টিতে পুকুরভরা মাছ থই থই করছে, লাফাচ্ছে। এক এক করে দুজনে অনেক মাছ ধরে খায়। মাছগুলো সুস্বাদু। সেটা দেখে মাছরাঙার লোভ জাগল। মনে বিভিন্ন রকম ফন্দি করে। বক যদি না থাকত, তাহলে একাই খেতাম। ওহ, কী শান্তি! সে আনমনা হয়ে স্বপ্নে বিভোর; দেখছে একা একা খাচ্ছে। আর ভেতরে ভেতরে চিন্তা করছে, কীভাবে বককে দূরে সরানো যায়। বক বিষয়টি বুঝতে পারে। মাছরাঙা তার উপস্থিতিতে রাগান্বিত হচ্ছে। বক আফসোস করে বলে, কিছুক্ষণ আগে আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম। এখন কেন ভালো লাগছে না। মাছরাঙা বন্ধুত্বের অমর্যাদা করছে। চলে যেতে চাইল, কিন্তু বাসায় মাছ না নিয়ে গেলে বাচ্চারা উপোস থাকবে।
মাছরাঙা বলল—বন্ধু শোন, তুই এই অংশে আর আমি ওই পাড়ের অংশের মাছ ধরব। ভাগ করে নিল। এভাবে কিছুদিন চলে। বক লক্ষ করল, ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরছে।

হঠাৎ একদিন মাছরাঙা মাছ ধরা নিয়ে বকের সঙ্গ বাগ্‌বিতণ্ডা করে। সামান্য লোভের মোহে সব ভুলে গেছে। গায়ে পড়ে ঝগড়া করে। বক খুব সাদাসিধে, তর্ক করে না। তার কথায় মুচকি হাসে। যতটুকু সম্ভব বুঝানোর চেষ্টা করে। বক বাসার পথে আসতে মাছরাঙার কথা ভাবছে আর কষ্ট পাচ্ছে। সামান্য মাছের লোভে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। ছিঃ, লোভ কী জঘন্য জিনিস। বক সিদ্ধান্ত নিল, সবকিছু তার বন্ধুকে দিয়ে আসবে। আর কখনো সে পুকুরে যাবে না। কিন্তু সকালে গিয়ে দেখে মাছরাঙা আসেনি। তাকে না পেয়ে সেদিন মাছ না ধরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরে গেল বক। দুপুরে আবার এল, দেখা পেল না। এবার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে গেছে। বক না খেয়ে কিছু মাছ সংগ্রহ করে বাসায় ফিরে এল। পরদিন খুব ভোরে গিয়েও বন্ধুর দেখা মেলেনি। হতাশ হয়ে গেল। কী হলো তার, চিন্তা করতে লাগল। কোনো শিকারি ধরে ফেলল না তো। দুশ্চিন্তায় বিড়বিড় করে বক বলে, সে আমার বন্ধু। ঝগড়াঝাঁটি হলেও সে আমার বন্ধু। সিদ্ধান্ত নিল মাছরাঙার বাসায় যাবে। কিন্তু বক তো বাসা চেনে না। মনে পড়ল, মাছরাঙাটি প্রতিদিন তমাল দিঘির পাড় থেকে আসে।

অনুমানে পথ চলতে লাগল। পথিমধ্যে শালিকের সঙ্গে দেখা। শালিক বলল, তুমি না মাছরাঙার বন্ধু। বক বলল—হুম, কী হয়েছে? শালিক বলে, আর বোলো না, দুই দিন আগে সে মাছ নিয়ে ফেরার সময় এক শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচে। পায়ে চোট পেয়েছে। খুব জ্বর গায়ে। বকের যেন কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। সে চিন্তা করল, বন্ধুকে দেখতে খালি হাতে কীভাবে যায়। নিজের বাসায় ফিরে আসে। নানারকম জলপোকা, জলজ ব্যাঙ মাছরাঙার প্রিয়। ওই পুকুর থেকে সুস্বাদু মাছ এবং সঙ্গে কিছু মজার পুষ্টিকর খাবার নিয়ে বন্ধুর বাসায় গেল বক।

মাছরাঙা দেখে অবাক। কীভাবে সম্ভব, আমি তো তোমার হক নষ্ট করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। ঝগড়া করেছি এমনকি ফাঁদ তৈরি করেছিলাম যেন তুমি চলে যাও। তারপরও আমাকে দেখতে এলে। বক বলল—থাক না ওসব। বন্ধুর এ অবস্থা শুনে না এসে কি থাকা যায়। অপরাধী হয়ে যাব। মাছরাঙা অতীতের কথাগুলো মনে করে অনুতপ্ত হয়। সব ভুলে আরও গাঢ় হয় তাদের বন্ধুত্ব।

শিক্ষার্থী, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, আইইউবিএটি