১৬ বছর সংসার করার পর লতা একদিন কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিল। রবির সঙ্গে আর থাকবে না সে। বিদেশে আরাম আয়েশ, বাড়ি-গাড়ি সব থাকার পরও এখনো সন্তানের মুখ দেখেনি। অথচ লতা সারা জীবন স্বপ্নটি দেখে এসেছে, বিয়ের পর তার কোলজুড়ে ফুটফুটে সন্তান থাকবে।
রবি দূতাবাসের একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। উপার্জনও অনেক ভালো। লতাকে বিদেশের বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। সমস্যা লতার, রবি এটা জানত। তবে কোনো দিন মুখ ফুটে কথাটি বলার সাহস হয়নি। কেবল বলেছিল, একটা বাচ্চা দত্তক নিলে মন্দ হয় না।

ভালোবাসার অফুরান অমৃত ঢেলেও সে লতাকে বেঁধে রাখতে পারল না। রবি জানে, যার মন একবার ছুটে গেছে, তাকে আর বেঁধে রাখা সমীচীন হবে না। আর চাইলেও সব সময় বেঁধে রাখা যায় না। মাধবীকেও আটকে রাখা যায়নি।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রবি। দারুণ মেধাবী। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় চার সন্তান নিয়ে খুব আর্থিক সংকটে পড়েন রবির মা। রবি তাঁর একমাত্র পুত্র, যেভাবেই হোক তাঁকে মানুষ করতে হবে। একদিন স্কুলশিক্ষক নীহাররঞ্জন সাহার সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেই থেকে এই নীহার স্যারের বাড়ি যাতায়াত শুরু রবির। বিনা পয়সায় রবিকে পড়াতেন তিনি। স্যারের মেয়ে মাধবীর যখন বিয়ে হয়, রবির মা তাঁর হাতের বালা দুটি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার দেন।

রবি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ মাধবীর বিয়ে ঠিক করে ফেলেন তাঁর বাবা। মায়ের চিঠিতে এই খবর জানার পর পাগলের মতো ছুটে যায় রবি। কিন্তু গভীর রাতে নীহাররঞ্জন এসে যখন রবির হাত ধরে বললেন, ‘বাবা তুমি আমার মেয়ের মান রাখো, ওকে তুমি নষ্ট করো না। আমি জানি তুমি ওকে কতটা ভালোবাসো।’
আর একটি কথাও বলতে পারেনি রবি। ছেলের মন ভাঙার পর মা আর বেশি দিন বাঁচেননি। এরপর শুরু হলো রবির নতুন জীবন। পরিশ্রম করে সরকারি চাকরি পায়, একটা সময় দূতাবাসে ভালো পজিশনে ঢুকে যায়। অর্থবিত্ত কোনো কিছুরই অভাব রইল না। এত দিন পর একটি সন্তানের জন্য আবার তার জীবনে অন্ধকার নেমে এল।
শুরু হলো রবির একা চলার দিন। বোনেরা বারবার তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। রবির একটাই কথা, সুখ ভাগ্যে থাকে। জোর করে সুখী হওয়া যায় না। বছরের একটা সময় ছুটিতে দেশে আসে সে।

রবি একজন স্বাস্থ্যস্বচেতন পুরুষ। নিয়মিত শরীরচর্চা ও খেলাধুলা করে। দেশে থাকাকালে নিয়মিত পার্কে হাঁটতে যেত। সেই অভ্যাসটা এখনো আছে।
দিনে দিনে মাধবীর শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে। সুস্থ থাকতে পার্কে হাঁটতে যাওয়া লাগে। এখানে অনেক মানুষ হাঁটতে আসে। কারও দিকে নজর দেওয়ার সময় কারও নেই।
পার্কে হাঁটার সময় রবি একদিন দেখল, মাধবীর মতো কিছুটা দেখতে একজন মহিলা। মাধবী হলে তার কপালে সিঁদুর থাকত, এই ভেবে বিষয়টা এড়িয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে ভাবতে গিয়ে অনেকটা দূর চলে গেল সে। রবির কাছে মাধবীর লাল বেনারসি পরা একটি ছবি ছিল। তাতে কপাল ভরা সিঁদুর আর হাতে তার মায়ের দেওয়া সেই বালা দুটি। বাড়ি ফিরে রবি সেই ছবিটা বারবার দেখে নিল। নিশ্চিত হলো এটাই মাধবী।
৩৭ বছর পর বিত্তবান রবিকে দেখে চেনার কথা নয়। তবু মাধবী এক দেখাতেই চিনতে পেরেছে। দুই বছর হলো সে সিঁদুর হারিয়েছে। আর সিঁদুর রক্ষার জন্য যে পাঁচ বছর যুদ্ধ করেছে, তাতে হারিয়েছে স্বাস্থ্য। এখন যুদ্ধ চলছে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার। কষ্ট করে ছেলে দুটোকে মানুষ করেছে। ছোট ছেলের জন্য বিয়ের পাত্রী খুঁজছে।

রবি যে এখন একা, তা আলাপে প্রকাশ পেয়েছে। তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজের ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে মাধবী নামটি যুক্ত করতে পারল না। সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে বসবাসের সময় কী কী সুবিধা ভোগ করা যায়, এ কথা শোনার পর থেকে মাধবী আর হাঁটতে আসেনি পার্কে।
যে চিঠিটা রবি মোমের আগুনে পুড়েছিল, ওটা লতার লেখা। দ্বিতীয় বিয়ের পরও সে মা হতে পারেনি। এখন আবার ফিরতে চায়। রবির হৃদয় ভালোবাসায় পূর্ণ বলে সে ঘৃণা করতে জানে না, এ কথা ঠিক নয়। সমাজ, ধর্ম আর সন্তানের কারণে রবি তার জীবনের সব ভালোবাসা হারিয়েছে।

পূর্ব বাসাবো, কদমতলা, ঢাকা