‘সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা’

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

২০১৯ সালের দিকে যখন বাফায় রবীন্দ্রসংগীত শেখা শুরু করি, কিছুদিন ক্লাস করার পর মনে হলো, আমাদের রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাসটা শুধু একটা সংগীতচর্চার ক্লাস না। আমরা গান গাই, গানের ব্যাকরণ শিখি, গানের পেছনের আবেগ জানার চেষ্টা করি, কোন গান কীভাবে জীবনের কোন পরিস্থিতির প্রতিফলন, এই সবকিছু মিলিয়ে গানের ক্লাস। শুধু গানের তত্ত্বীয় ব্যাপার শিক্ষার ক্লাস না, আমরা দর্শন শাস্ত্রের ক্লাসও করি। আমার ব্যক্তিত্বের যদি কোনো ইতিবাচক উন্নতি হয়ে থাকে, তাহলে তার ৭০% হয়েছে বাফায় গান শিখতে আসার পর থেকে। এর পেছনে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব গানের শিক্ষিকা সামিনা খানম শেলী ম্যাডামের। শুধু কণ্ঠ সাধনাতেই যে গান সীমাবদ্ধ নয়, গানটা যে আত্মার খোরাক, মানসিকতা উন্নত করার একটা উৎস সেটা আমাকে এই মানুষটা শিখিয়েছেন। শুধু ঐ মুহূর্তটায় বাঁচাটা, সম্পূর্ণ মন-প্রাণ উজাড় করে গাওয়ার আনন্দ, শান্তি অনুভব করার শিক্ষাটা এই মানুষটার কাছে পেয়েছি।

একদিন ক্লাসে কোনো এক প্রসঙ্গে ম্যাডাম বললেন, ‘অনেকেই তো আসলে গানটা ধরে রাখতে পারে না। বিভিন্ন কঠিন বাস্তবতার কারণেই আসলে ছেড়ে দেয়।’ তারপর তিনি আমার দিকে দেখিয়ে বলেন, ‘আমার কেন যেন মনে হয় ও গানটা ধরে রাখতে পারবে। আমি ভুলও হতে পারি। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, ও পারবে।’

কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না; আমার ঐদিন, ঐ কথাটা শুনে, ঐ মুহূর্তে গায়ের প্রত্যেকটা লোম দাঁড়িয়ে গেল। জীবনে প্রথমবার কারও মুখে নিজের প্রশংসা শুনে চোখে পানি এসে পরার মতো অবস্থা হয়েছিল। একটা মানুষের আমার ওপর এতটা বিশ্বাস।

দুই বছর করোনার প্রকোপে ক্লাস হলো অনলাইনে। ক্লাসে অনেক ফাঁকিবাজি করেছি। কোনোরকম অনুশীলন করে গানের পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু গানটা আমি একেবারে ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করারও সাহস করতে পারিনি। এমন না যে বাধ্য হয়ে গান ধরে রেখেছি। মন থেকে গান ছাড়তে পারব না দেখেই ছাড়িনি৷ গান আমার জন্য মেডিটেশন। শুধু গান গাওয়ার সময় আমি পৃথিবীর আর সব কিছু ভুলে যেতে পারি। ‘অনেকেই কন্টিনিউ করতে পারে না’, সেই অনেকের মধ্যে আমিও একজন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু হইনি, হয়তো ম্যাডামের ঐ একটা কথার কারণেই, ‘ও পারবে।’ ম্যাডামের বলা একটা কথা, ‘কেন যেন মনে হয় ও পারবে’র কারণেই হয়তো আমি হাজারবার ফাঁকি দেওয়ার পরও গানটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। প্রতিবার নিজেকে হারিয়ে ফেলার মুহূর্তে গানের মধ্যে দিয়ে ফেরার চেষ্টা করেছি।

ম্যাডাম, আপনি কি জানেন, আপনার এই একটা আমাকে কতবার পড়ে যেতে নিয়েও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে? ক্লাসে আপনার কানে যেন আমার কণ্ঠটা যায়, সে জন্য নিজ থেকে আপনি আমাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে গান করানোটা যে আমার জন্য কত বড় পাওয়া; এইটুকু ভরসা যে আমাকে কতটা সাহস দেয়, তা বলে বোঝাতে পারব না। ভবিষ্যতে গান নিয়ে বড় কোনো পর্যায়ে যেতে পারলে, অবদান সবচেয়ে বেশি থাকবে এই মানুষটার। তিনি আমাকে গানের ভেতরে ঢুকে, গানকে ধারণ করে গাইতে শিখিয়েছেন। এর জন্য সারা জীবন ওনার কাছে ঋণী থাকব।

শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়