শহীদ ছবুরের জন্মকথা
গাজী আবদুস ছবুর ১৯৫১ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শেয়ানপাড়ার গাজীবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গাজী আলী চাঁন সওদাগর ছিলেন পেশায় একজন লবণ ব্যবসায়ী এবং মাতা ছমেরাজ খাতুন গৃহিণী। গাজী আলী চাঁন সওদাগরের তিন পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের মধ্যে গাজী আবদুস ছবুর ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বড় ভাই গাজী আবদুছ ছালাম ছোটবেলায় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোট ভাই গাজী সেলিম পেশায় ব্যবসায়ী এবং ছোট দুই বোন জরিনা বেগম ও জাহেদা বেগম।
শৈশব ও ছেলেবেলা
গাজী ছবুর ছোটবেলা থেকে বেশ দুরন্ত ও চঞ্চল ছিলেন। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ছিল প্রিয় খেলা। কৈশোরে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করে ছুটে বেড়াতেন। ছিলেন রসিক ও আমুদে প্রকৃতির। বন্ধুদের মন খারাপ থাকলে কৌতুক আর হাসির গল্প শুনিয়ে মন ভালো করে দিতেন।
গাজী ছবুরের কণ্ঠ ছিল অসাধারণ। গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরতেন। সব সময় বাড়ির সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। গ্রামে গায়েহলুদ, মেজবান বা বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি থাকত।
স্কুলবেলায় বন্ধুদের নিয়ে শেয়ানপাড়ার অদূরবর্তী বাঁকখালী গ্রামের পশ্চিম বিলে চড়ুইভাতির আয়োজন করতেন। দিনভর বাঁকখালীর বাঁকে জাল পেতে মাছ শিকার করতেন। রাতভর চড়ুইভাতি খেলে বাড়ি ফিরতেন। জ্যোৎস্নাভাঙা রাতে গানের আসর বসাতেন পুকুরঘাটে। বাড়ির ছোট শিশুদের খুব ভালোবাসতেন এবং গ্রীষ্মকালে দল বেঁধে পুকুরে ডুব–সাঁতার, কখনো ফুটবল, কখনো-বা দাঁড়িয়াবান্ধা, বউচি, কানমাছি খেলতে খেলতে বেলা কাটিয়ে দিতেন। দুরন্ত ও দস্যিপনায় বেড়ে ওঠেন গাজী ছবুর। বলতেন, ‘ফুল এবং শিশু দুটোই আমার প্রিয়।’
শিক্ষাজীবন
শেয়ানপাড়া গ্রামের পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক এবং আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে পটিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সে সময় পটিয়া কলেজে ছাত্রলীগের ‘কান্ডারী’ ও ‘দিশারী’ নামে দুটি সংগঠন ছিল।
শহীদ ছবুর প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় কান্ডারী সংগঠনে যোগ দেন। তিনি পড়ালেখায় যেমন মেধাবী, তেমনি সাহসীও ছিলেন। পটিয়া কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইতেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও স্মৃতিকথা
১৯৭১ সালে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কান্ডারী গ্রুপের অন্যতম ছাত্রনেতা গাজী আবদুস ছবুর (২১) তখন পটিয়া সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিটেয়ের ছাত্র। বেশ বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। একবার খানমোহনা রেলস্টেশনে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেই আক্রমণে গাজী আবদুস ছবুরও ছিলেন। অপারেশনে তিনজন রাজাকার মারা যায়। সে সময় গাজী ছবুরসহ মুক্তিযোদ্ধারা হাইদগাঁও বড় মিয়ার দরগাহ (পূর্ব দরগাহ নামে পরিচিত) হাজীর মাঠে অবস্থান নেন। সেখানে মশার যন্ত্রণায় নাকি বসা যেত না, ঘুমাতে পারতেন না মুক্তিযোদ্ধারা। এক বিকেলে গাজী ছবুর সহযোদ্ধাদের বললেন, ‘বন্ধুরা, ভয় পেয়ো না। বিষাক্ত মশাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মশাকে ভয় পেলে রাজাকার, পাকবাহিনী কেমনে খতম করবা? এই দেখো, আমি একসঙ্গে ১০টা মশা খতম করে দিয়েছি।’ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গাজী ছবুর ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। যুদ্ধ শেষে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ফিরলেও আবদুস ছবুর বাড়ি ফেরেননি। কী ঘটেছিল সেদিন?
যেভাবে শহীদ হলেন গাজী ছবুর
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহাবুবের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর শনিবার ছবুরসহ তাঁরা গিয়েছিলেন ভট্টাচার্য হাটে। ঘাতক রাজাকার রশিদের ভাই মনু মিয়াকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যান সেখানে। মনু মিয়া পটিয়া থানাহাটের হাসিল (টোল) আদায় করতেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতেন এবং অত্যাচার করতেন।
অপারেশনে যাওয়ার সময় ছবুরের সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী মাহাবুব, এস এম ইউসুফের ভাই নাছির উদ্দিন, আহমেদ ছফা চৌধুরী প্রমুখ। মনু মিয়াকে আবদুস ছবুর পেছন দিক থেকে জাপটে ধরেন। ‘এই কোথায় যাচ্ছিস তুই’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। মনু মিয়াকে দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরেন। গাজী ছবুর ছিলেন শক্তিশালী। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শামসুদ্দিন হঠাৎ স্টেনগান দিয়ে ফায়ার করেন মনু মিয়াকে। সেই গুলি মনু মিয়ার শরীর ভেদ করে গাজী ছবুরের বুকে ও ডান হাতে ছয়টি বুলেট বিদ্ধ হয়। রাজাকারের ভাই মনু মিয়ার সঙ্গে ছবুরও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বুকে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় তিন ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়েন। গাজী ছবুর মৃত্যুশয্যায় বারবার বলছিলেন, ‘খবরদার! তোরা হাত থেকে অস্ত্র ফেলবি না বন্ধু। আমি মরে গেলেও দেশ স্বাধীন হবে। আমার মৃত্যুর খবর মাকে বলবি না। তাঁকে বলবি, আমি ইন্ডিয়ায় ট্রেনিং নিতে গিয়েছি। পারলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যা।’
সে সময় হাইদগাঁও এলাকার বাসিন্দা নবীকে (আমিনার বাপ) দিয়ে সামান্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। তখন হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। চারদিকে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর উৎপাত। একসময় ভট্টাচার্য হাটে শাহাদাতবরণ করেন গাজী ছবুর।
শামসুদ্দিন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। শহীদ আবদুস ছবুরের লাশ মাটিতে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুব, আহমেদ ছফা, নাসিরসহ পাহাড়ি এলাকার কিছু লোক মিলে লাশটি বাঁশের তৈরি মাচাংয়ে করে কেলিশহরের খিল্লাপাড়ার গুড়টিলা পাহাড় থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে ভুঁড়িপাড়ায় নিয়ে যান।
শহীদ গাজী আবদুস ছবুরের রক্তমাখা সেই জামা প্রায় ১২ বছর সংরক্ষণ ছিল দাদি মরহুমা জোবেদা খাতুনের কাছে (গাজী আমিন মঞ্জিলে)। পরে উইপোকা জামাটি খেয়ে ফেললে আর সংরক্ষণ করা যায়নি।
প্রথমে শেয়ানপাড়া গ্রামের, এমনকি পরিবারের কেউ জানত না যে গাজী আবদুস ছবুর শহীদ হয়েছেন। এক দিন পরে শেয়ানপাড়ার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ কবির শহীদ ছবুরের চাচা মৌলভি আবদুল লতিফকে (প্রকাশ লালু ফকির) মৃত্যুর সংবাদটি প্রথমে জানান। ওদিকে মা ছমেরাজ খাতুন তাঁর সন্তানের জন্য প্রতীক্ষায় রইলেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফিরলেন। ছমেরাজ খাতুন তাঁর কলিজার টুকরা গাজী ছবুরের জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি ছোট ছেলে গাজী সেলিমকে বলেন, ‘তুই একটু খবর নে বাবা, তোর মাজু ছবুর কেন বাড়ি আসছে না। ছেলেটা না খেয়ে আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ফিরেছে, সে কেন ফিরছে না?’ একসময় মা জানতে পারেন তাঁর সন্তান আর নেই। প্রিয় সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
শহীদ আবদুস ছবুরের মৃত্যু নিয়ে আজও অনেক মুক্তিযোদ্ধার মনে কৌতূহল ও রহস্য রয়ে গেছে। মৃত্যুর পর তাঁর কবরটি পর্যন্ত নিজ ভূমিতে আনা হয়নি। দিশারী গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ‘ছবুরকে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মারেনি। মনু মিয়াকে মারতে গিয়ে, গাজী আবদুস ছবুর দুর্ঘটনায় শাহাদাতবরণ করেন।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শামসুদ্দিন বলেন, ‘আমার বন্দুকের গুলিতে ছবুর শাহাদাতবরণ করেন। আসলে এটা ছিল একটা দুর্ঘটনা।’
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছবুরকে কেলিশহরের খিল্লাপাড়া গুড়টিলা পাহাড়ের লেকের পাশে শেষ গোসল দেওয়া হয়। পরিধানের লুঙ্গি দিয়ে কাফন তৈরি করে দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধা মিলে ছোট পরিসরে জানাজা পড়েন। ওই দিন রাতে গুড়টিলা পাহাড়ের মাটিতে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েন শহীদ ছবুর।
স্মরণে শহীদ ছবুর
১৯৭২ সালে পটিয়া মুন্সেফ বাজারে শুকুর আলী মুন্সেফ মসজিদের পাশে ‘অগ্রপথিক সংঘ শহীদ ছবুর স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা করেন দুবাইয়ে কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল আলম ও তাঁর সহপাঠীরা। কালের বিবর্তনে সেটিও হারিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে তাঁর স্মরণে পটিয়া সদরের প্রাণকেন্দ্রে থানার মোড়সংলগ্ন শহীদ ছবুর রোড নামে একটি সড়কের নামকরণ হয়।
বর্তমানে পটিয়ার কেলিশহরের খিল্লাপাড়ায় শহীদ আবদুস ছবুরের নামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পেছনে বেশি ভূমিকা রয়েছে পটিয়া গৌরব সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াত আইনজীবী হরিসাধন দেব ব্রাহ্মণ ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর।
২০১৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে ‘একাত্তরের শহীদ ছবুর’ নামে জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার পর একটা বিস্মৃত অধ্যায় সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারে। বইটির আলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গ্রুপ খোলা হয়। গ্রুপটির নাম ‘একাত্তরের শহীদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ’। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
২০১৯ সালে ২৮ মার্চ পটিয়ায় শহীদ ছবুর শিশুতোষ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। দীর্ঘ ৫১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৯ মে ২০২২ শহীদ ছবুরের নাম গেজেটভুক্ত করে।
লেখক ও প্রাবন্ধিক