শুভ্রের সঙ্গে পরিচয় বছর চারেক আগে, অনার্স জীবনের প্রথমে। আমাদের দেখা হয় ক্যাম্পাসের মূল ফটকে ভ্যান থেকে দুজনের একই ফুলগাছের চারা পছন্দ হওয়া নিয়ে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সে গাছটা আমায় নিতে দেয়। আমিও ভদ্রসুলভ একবার বলেছিলাম, ‘না, না, আপনি আগে গাছটি পছন্দ করেছেন, আপনি নেন।’ শুভ্রের পাশের বন্ধুটি বলল, ‘আপু আপনি নিয়ে নেন। সুন্দরীদের খালি হাতে ফিরতে নেই।’ আমি মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিন গাছটি নিয়ে নিই।
যেদিন শুভ্রের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ গড়ে ওঠে, সেদিন ছিল ৪ শ্রাবণ। ভুবন কাঁপানো মুষলধারে বৃষ্টিরা নৃত্য করে যাওয়ার পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আগমন ঘটেছে ধরণিতে। সবাই তখন ক্যাম্পাস থেকে বাড়ির পথে। হঠাৎ কারও ডাকে পেছনে ফিরে তাকাই। শুভ্র কিছুটা দৌড়ে আসছে আমার দিকে। গৌড় বর্ণের অধিকারী শুভ্রের দিঘল জোরা চোখ। দিঘির জলের মতো শান্ত স্বচ্ছ তার দৃষ্টি। অত্যন্ত চুপচাপ স্বভাবের। কাছে এসেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নামটা যেন কী?’
‘স্নিগ্ধা।’
‘আপনার গাছটা কি বেঁচেছে?’
‘হ্যাঁ, আপনি কি এটা জানার জন্য এভাবে আসলেন?’
শুভ্র হেসে বলল, ‘না, আপনার একটা বই আমার কাছে আছে। সেদিন গাছ কিনতে গিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। বিভূতিভূষণের “অপরাজিত”।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বইটা নিলাম। শুভ্র এবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি প্রকৃতি পছন্দ করেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘এমনটাই ধারণা করেছিলাম। আপনার অনুমতিবিহীন বইটা পড়েছিলাম। মাফ করবেন।’
‘সমস্যা নাই।’
সেদিন শুভ্রের কাছে ছাতা ছিল না। আমিও ছাতা বন্ধ করে ঢুকিয়ে নিলাম ব্যাগে। ক্যাম্পাসে তখন প্রেমিক যুগলদের হাতে কদমের ছড়াছড়ি। গাছে গাছে সজ্জিত কদমগুলো জানান দিচ্ছে বর্ষার সৌন্দর্য। শুভ্র জিজ্ঞেস করল, ‘কদম কেমন লাগে আপনার?’ আমি বললাম, ‘বেশ ভালোই লাগে।’
সে আমায় কদম অফার করল। আমি ‘না’ বললাম। কারণ জানতে চাইল। বললাম, ‘আমার কখনো কদম ছোঁয়া হয়নি।’
শুভ্রর চোখেমুখে জানার কৌতূহল। জানতে চাইল, ‘কেন?’
বললাম, ‘প্রিয় মানুষের জন্য না হয় কদমটা তোলা রইল।’
‘বাহ্! দারুণ তো।’
সেদিন বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে হাঁটতে নিজের একটা কঠিন সত্য বলে ফেললাম তাকে। তারপর আমাদের প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা হতো। মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে দু–এক দিন দেখাও হতো। এভাবে তিন বছর কেটে যায়। আমরা ভাসি এক অজানা নামহীন সম্পর্কের সাগরে। একদিন শুভ্র একটি চিঠি পাঠায়। সে আমায় স্নিগ্ধা নামে ডাকত না। ‘স্নিগ্ধ’ ডাকত।
‘প্রিয় স্নিগ্ধ,
এই বর্ষায় আমি যদি তোমার গৃহদ্বারে একগুচ্ছ কদম নিয়ে কড়া নাড়ি, তুমি কি দ্বার খুলে তা গ্রহণ করবে?’
চিঠির প্রত্যুত্তরে আমি পাঠালাম, ‘শুধু কদম নয়। কদম বহনকারী বর্ষার দূতকেও গ্রহণ করতে আমার দ্বিধা নেই।’
তারপর তার আসার দিন মনমতো সেজে অপেক্ষা করলাম তার জন্য। সে এল না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামল, ভিজিয়ে দিল আমার শরীর। খবর এল, এই বর্ষার এই শ্রাবণে সে রাজপথে বুক পেতে দিল। তার হাতের কদমগুচ্ছ লাল বর্ণ ধারণ করে মাটিতে লুটিয়ে ছিল। আমি অপেক্ষা করলাম আবার কোনো বর্ষার জন্য।
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ