যেন হৃদিতার মতো ভালোবাসতে পারি

হৃদিতা’ ছবিতে পূজা চেরি

জীবন কঠিন, সমুদ্রতটের বালুকণার মতো অনির্বচনীয় অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। প্রিয়জনের চলে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট, অপ্রাপ্তি, বিরহ-বেদনা ইত্যাদি। তবু জীবন নিরুপম, সুন্দর ও স্বপ্নময়। বৃষ্টির মতো টুপটাপ ঝরে পড়া অল্প-বিস্তর সুখের মুহূর্তগুলোই বেঁচে থাকার পথ দেখায়। তার মধ্যেও কখনো কখনো নিঃসঙ্গতার নিপীড়নে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। তখন আমি বই পড়ি, গান শুনি, নাটক-মুভি দেখি, মা-বাবা-বোনের সঙ্গে কথা বলি।

এমনই এক মন খারাপের দিনে মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখার রসদ ‘বই’ নেওয়ার জন্য বসার ঘরে গেলাম। জেঠিমা তিন সিটের লম্বা সোফাতে শুয়ে বই পড়ছিলেন। বুকশেলফে বই হাতড়াচ্ছি দেখে তাঁর হাতের বইটা দেখিয়ে বললেন, ‘এইটা পড়। চমৎকার বই, পড়ে আনন্দ পাবি।’ আমি বইটা নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। ‘হৃদিতা’ একটা প্রেমের উপন্যাস। ভূমিকার প্রথম বাক্য দুটি পড়তেই আহত হলাম। মন খারাপের দিনে মন খারাপের গল্প পড়ব না ভেবেও পড়া শুরু করলাম। ‘হৃদিতা’ ক্রমে ক্রমে হৃদয়ে প্রবেশ করল।

এরপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর। আমি বর্তমানে স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পড়ছি। ক্লাসের মতো চেহারা, কথাবার্তা, চালচলন, চিন্তাভাবনা সবই কমবেশি বদলেছে। কিন্তু ‘হৃদিতা’ পাঠের অনুভূতি একই আছে, একটুও বদলায়নি। আজও আমি হৃদিতার মতন বিশাল ভালোবাসার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মানুষকে জীবনে প্রার্থনা করি। যে কারণে-অকারণে, বিপদে-আপদে প্রতিটি মুহূর্তে একইভাবে আমাকে ভালোবাসবে, জাপটে থাকবে। আনিসুল হকের প্রেমের উপন্যাস ‘হৃদিতা’ সাধারণ জীবনের অসাধারণ গল্প। চারপাশে কান পাতলেই এর রেশ শোনা যায়।

‘হৃদিতা’ নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। তারপরও নিজেকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। খুব ইচ্ছা ছিল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির দিনেই ‘হৃদিতা’ দেখব। কিন্তু অনিবার্য কাজে আটকে পড়ায় ৭ অক্টোবর দেখা সম্ভব হয়নি। ‘হৃদিতা’ দেখেছি ৯ অক্টোবর, যশোরের মণিহার সিনেমা হলে। আনিসুল হকের গল্প ও সংলাপে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন ইস্পাহানি আরিফ জাহান। মূল দুটি চরিত্র, হৃদিতা ও কবির চরিত্রে অভিনয় করেছেন পূজা চেরি এবং এ বি এম সুমন।

পছন্দের উপন্যাস মানেই নিজের মস্তিষ্ক ও চোখে একটি জীবন্ত দৃশ্যপট। ভেবেছিলাম, কত দূর কী হবে! ‘হৃদিতা’ চরিত্রের অভিনয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল ছিল। না, আহত হইনি, পূজা চেরির অভিনয়ে আনন্দিত হয়েছি। তাঁর বাচনভঙ্গির সারল্য, এক্সপ্রেশন ভালো লেগেছে। শিল্পীমাত্রই স্বাধীন, উপন্যাসের কবির চরিত্রের এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ বি এম সুমনের অভিনয়ে বিষয়টি ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে চলচ্চিত্রের অন্য সবার অভিনয়ও ভালো ছিল। তবে বেশ কয়েকবার যেহেতু বইটা পড়েছি, সেহেতু অনুভূতিও দৃঢ়। তাই মনে হয়েছে হৃদিতার মা–বাবা ও বান্ধবী চরিত্রের অভিনয়টা আরও একটু চিত্তাকর্ষক হতে পারত। তবে শেষের দিকে হৃদিতার মা চরিত্রের কান্নার অংশটুকু হৃদয়গ্রাহী, চোখে লাগার মতো। আর ‘ঠিকানাবিহীন’ ও ‘শুধু একবার ছোঁব’ গান দুটির কথা বলতেই হবে। সব মিলিয়ে আশাহত হইনি, বরাবরের মতো দুর্বল চিত্ত কেঁপে উঠেছে। গালের ওপর চোখের জল নুয়ে পড়েছে অজান্তে।
জীবনের কতিপয় দুঃখ, কিছু কিছু মানুষ আর কিছু অনুভূতির জন্য চোখের জল ফেললে বিশুদ্ধ আনন্দ হয়। বোধ করি ‘হৃদিতা’ও তেমনি একটি চরিত্র, একটি গল্প, একটি অনুভূতি, একটি সাহস, একটি অকপট আশ্রয়, যার জন্য  চোখের জল শোভা পায়। অস্বার্থপর ভালোবাসার গল্প ‘হৃদিতা’ চিরদিন হৃদয়–গহিনে রয়ে যাবে। ভালোবাসার ক্ষমতা বিশাল। ভালোবাসাও শেখা প্রয়োজন, সে গল্প থেকে হোক আর উপন্যাস কিংবা দর্শন থেকেই হোক, শিখতেই হবে। কারণ, পৃথিবীর প্রস্থে প্রস্থে যে স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ সব মোছার জন্য অমোঘ অস্ত্র ভালোবাসার প্রয়োজন।