সাহিত্যের দীপ্তিময় নক্ষত্র আহমদ ছফা: স্মৃতি, অবদান ও আমাদের ঋণ
শিক্ষাজীবন থেকে লেখক আহমদ ছফার নাম শুনেছি। দুর্ভাগ্য হলো, তাঁর সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। দীপ্তিমান এই লেখকের বই পড়ে জানলাম, তিনি অনেক উঁচু কাতারের একজন লেখক। সেই অজানা কৌতূহল থেকে তাঁকে জানার আগ্রহ। গত পৌষের শেষের দিকে আহমদ ছফার স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের সাহিত্যপাড়া পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।
আঁকাবাঁকা রাস্তা। সবুজ শ্যামল পাখিডাকা ছায়াঘেরা ছবির মতো সুনিবিড় গ্রাম। গ্রামের ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ল দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানেই জীবনের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন আহমদ ছফা। পরবর্তী সময়ে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দুঃখের বিষয় হলো, দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোথাও আহমদ ছফার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
সাহিত্যপাড়ায় বাপ-দাদার ভিটেবাড়িটি এখন শুধুই স্মৃতি। লেখকের খুব কাছের প্রতিবেশী নাতি সম্পর্কীয় তারেক জানালেন, লেখকের একটা মাটির ঘর ছিল, বর্তমানে নেই। বাড়ির পাশ দিয়ে ধীরগতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে বরুমতি খাল।
কথাশিল্পী আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে পরবর্তী সময়ে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা (অসম্পূর্ণ) জার্মান ভাষা ডিপ্লোমা করেন।
ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু আহমদ ছফার। ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। কৃষক আন্দোলন সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে কারাবরণও করেছিলেন। দৈনিক গণকণ্ঠ ও ‘সাপ্তাহিক উত্তরণ’-এ লিখতেন এবং তিনি সাপ্তাহিক উত্তরণের সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলা জার্মান সম্প্রীতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
লেখক একের পর এক অনবদ্য রচনা লিখে গেছেন। গুরু-শিষ্য নিয়ে আহমদ ছফার অনবদ্য রচনা ‘যদ্যপি আমার গুরু’। অর্ধশতাধিক বই রচনা করেছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাংলা ভাষা’, ‘রাজনীতির আলোকে’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা’, ‘নিকট দূরের প্রসঙ্গ’, ‘সংকটের নানা চেহারা’, ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা’, ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র’, ‘আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ ইত্যাদি। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘উদ্ধার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’, ‘অলাতচক্র’, ‘ওঙ্কার’, ‘গাভী বিত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’, ‘নিহত নক্ষত্র’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও কবিতার বই, কিশোর গল্প, শিশুতোষ ছড়া, ভ্রমণকাহিনিসহ নানা সাহিত্য রচনা করেছেন।
সাহিত্যের মধ্যে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক কিংবদন্তি আহমদ ছফা। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, মৃত্যু জীবিতদের জন্যে স্পেস সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে।’
২০০১ সালের ২৮ জুলাই আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্যজগতের উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্রের শেষের ঠিকানা হলো মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। তাঁর কবরের নকশা করেছিলেন শিল্পী রশীদ তালুকদার এবং সমাধির ইট ক্রয়ের টাকা দিয়েছিলেন সিলেটের ওবেইদ জায়গীরদার। কবরটি লাল টালি ইটের ঘেরা, মাঝখানে সবুজ দূর্বাঘাসের চাদর, পাশে কামিনী ফুলের গাছ দেখে মুগ্ধ হলাম। ভাবলাম দেশের মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী স্পষ্টবাদী লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে চিনতে না পারলেও প্রকৃতি ঠিকই চিনেছেন। প্রকৃতি তাঁর নিজস্ব তুলি দিয়ে সমাধিটি সাজিয়েছে।
তবে দুঃখের বিষয় হলো সাহিত্যিক আহমদ ছফার নামে আজও তাঁর গ্রামে কোনো স্মৃতি সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে জনশ্রুতি আছে, জার্মানির ভেৎসলার শহরের মহাকবি গ্যোটের স্মৃতিবিজড়িত শহরে আহমদ ছফার নামে কিয়স্কটি (পানশালার) নামকরণ করা হয়েছে।
লেখকের ৮২তম জন্মবার্ষিকীতে প্রধান উপদেষ্টা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং চন্দনাইশ উপজেলা প্রশাসনের প্রতি সবিনয় নিবেদন, আহমদ ছফা স্মৃতিবিজড়িত গাছবাড়িয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার স্থাপন, সড়কের নামকরণের মাধ্যমে আহমদ ছফার স্মৃতি সংরক্ষণ করা হোক। পাশাপাশি আহমদ ছফাকে মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পদক দেওয়ার মাধ্যমে যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মাননা দেওয়া হোক।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা