অতীত একটি ভিনদেশ: শূন্যতা ও হাহাকারে আখ্যান

মলাটের ওপর খোদাই করা বইয়ের শিরোনাম যেন বই-অন্তস্থিত সারবস্তুর এক সম্ভাবনাময় ইঙ্গিত! মোজাফ্ফর হোসেনের গল্পবই এটি। এই বইয়ের গল্পগুলো পড়লে পাঠক হারিয়ে যায় অতীতে। এই অতীতের সঙ্গে মোটামুটি সব পাঠকই হারিয়ে ফেলা নিজ জনপদের ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে যোগ করতে পারবেন! এ ছাড়া গ্রন্থটিতে ঠাঁই পাওয়া প্রতিটি গল্পই যেন পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার এক অদৃশ্য সুতার টান!
১৪টি গদ্যবয়ানের সবগুলোতেই খুব কমন কিছু বিষয় জড়িয়ে রয়েছে; অতীতের প্রতি তীব্র নস্টালজিয়া, ক্ষয়িত সংসারের কঙ্কালময় চিত্র, হাল আমলের পেশিশক্তির প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ, আছে কলোনিয়াল দাসত্ববৃত্তির পরোক্ষ কিছু শক্তিশালী আঁচড়। অধিকাংশ গল্পের উঠানজুড়ে আছে অসাম্প্রদায়িক সমাজের হারানো সুর-চিহ্ন, আছে দেশভাগের কষ্ট-রেখা, মানবহৃদয়ের সহজাত প্রেম ও বিরহের মাপা মানচিত্র।

গল্পকথকের সঙ্গে হুট করে সাগরপাড়ে দেখা হওয়া বাঁশিওয়ালা মজ্জেল ও দুজনের ভেতরকার কথোপকথন পাঠককে দাঁড় করায় পরাবাস্তবতার এক বালুকাবেলায়। সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে কী করে হারিয়ে যায় এক নরসুন্দর বাঁশিওয়ালা, কী করে গল্পের শেষে এসে পাঠক জানতে পারে গল্পের দুটি চরিত্রই মৃত, তা-ই জানান দেয় ‘বাঁশিওয়ালা মজ্জেল’ গল্পটি। গল্পকার তাঁর ‘আমার গল্পভাবনা’ শীর্ষক প্রাক্‌–কথনে দাবি করেন, তিনি সমকালীন সমস্যা ও বিষয়কে উপজীব্য করে লেখেন। তাই আলোচ্য গল্পটিতেও পাঠকেরা দেখতে পাবেন, আধুনিকতার সুবাতাস যেখানে মানুষকে সমুদয় সংস্কারমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করবে বলে প্রত্যাশা ছিল, সেখানে উল্টো পুরো পৃথিবীটাই যেন ডান দিকে ঘুরে গিয়ে ধর্মের নামে অধর্মের অনাসৃষ্টি করে ধর্মকে করেছে ম্লান, করেছে প্রশ্নবিদ্ধ।

যে বাঁশিওয়ালা একসময় বাঁশিতে সুর না তুললে পুরো গ্রাম অসুস্থ হয়ে যেত, কী এক অদৃশ্য ফুঁয়ে সবাই হঠাৎই বাঁশিওয়ালা মজ্জেলকে নেভাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছুদিন নিখোঁজ থাকার পর মজ্জেলকে একটি খোলা মাঠে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। কেউ বলল, মজ্জেল তেষ্টায় মারা গিয়েছিল, কেউ বলল, জিন–ভূতের আসরে কিংবা মৃগীরোগে...। সবার শেষে গল্পকথক তার দাদির বক্তব্যকে সমর্থন করে জানায়, মজ্জেল বাঁশিতে ফুঁ দিতে না পারার তেষ্টায় মারা গিয়েছিল। বাঁশিওয়ালা মজ্জেল বাঁশিতে ফুঁ দিতে না পারা তেষ্টায় মরে গিয়ে প্রমাণ করল মানুষ প্যাশন ছাড়া বাঁচে না। মজ্জেলের প্রয়াণ যেন সমস্ত কুংস্কারের কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ!
‘লাশটি জীবিত, বাকিরা মৃত’ শীর্ষক গল্পটি হাল আমলে এসে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। বহুতল বিল্ডিং নির্মাণের সময় পা হড়কে বাঁশে গেঁথে যাওয়া নির্মাণশ্রমিকের নির্মম ঝুলে থাকার ভয়ানক চিত্রটি যেন করপোরেট শক্তির স্বরূপ প্রকাশের দেয়াল পোস্টার! করপোরেট পক্ষ অথবা রাষ্ট্রপক্ষের কাছে হতদরিদ্রের জীবনের মূল্য খুবই তুচ্ছ অথবা নেই—এই সহজ সত্যটি ফুটে উঠেছে গল্পটিতে। এ ছাড়া একই গল্প ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের বহুল প্রচারের উপকারিতা-অপকারিতার বিষয়ে পাঠককে পুনর্বার জাগ্রত করে। অকুস্থলে গণমাধ্যমের হামলে পড়লে দিনের পর দিন পরিত্যক্ত পলিথিনের মতো ঝুলে থাকা লাশটি নামানোয় পুলিশ কিংবা ভবনমালিকের সীমাহীন উদাসীনতা যেন মুহূর্তে উবে যায়। অথবা সেই গল্পে প্রমাণ মেলে কীভাবে গণমাধ্যমের অতি উৎসাহের ফলে নজর এড়ানো তিলও নজরকাড়া তাল হয়ে যায়। শেষতক গল্পটি আরও প্রমাণ করে যে গণমাধ্যম হোক, ভার্চ্যুয়াল মাধ্যম হোক; কোনো পক্ষই প্রলেতারিয়েতদের জন্য নয়। সবই বেনিয়াগোষ্ঠীর আজ্ঞাবাহী।

ঘুম পাড়ানো জল। গল্পটি দেশবিভাগের কুফল ও স্বাধীনতা-উত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পুনর্জাগরণের পরিসংখ্যান-গ্রাফ। বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের পটভূমিকায় এত বেশি কাজ হয়েছে, যে কারণে দেশভাগ নিয়ে লেখা প্রায় সব নির্মাণেই একই ধরনের হাহাকার ও নস্টালজিয়ার কথা ফুটে ওঠে। মোজাফ্ফর হোসেনের এই গল্পবয়ানও তাই। ‘সুখ অসুখ’ গল্পটি হাল আমলের যুবকদের মনোযন্ত্রণার সঠিক চিত্রায়ণ। এই জনপদের মানুষজন যবে থেকে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামো থেকে আলগা হয়ে চাকরবৃত্তিতে মনোযোগী হয়ে ওঠে, উপজাত উৎপাদ হিসেবে তখন থেকেই শুরু হয় নতুন সংকট, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, ক্যারিয়ার কম্পিটিশন। মানুষ নিজের অবস্থানে যে কেউ সুখী নয়- এই প্রতিষ্ঠিত সত্যকে আরও একবার অক্ষর-আঁচড়ে তুলে এনেছেন এই গল্পকার। শেষ গল্প ‘ছুঁয়ে দেখা জীবন’ও একই গল্প বলে। দুটো প্রজন্মের ভেতরে তৈরি হওয়া ভিন্ন দর্শন।
যে রহমান সাহেব মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে অতীতের স্মৃতিতে ডুবে গিয়ে পুরোনো কথার মালা পুনরায় নিজেকে গাঁথতে ব্যতিব্যস্ত, সেই রহমান-ই তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূর কাছে মানসিক বিকারগ্রস্ত। এই বৈকল্য যে কেবল রহমানের তা নয়, মৃত্যুপথযাত্রী প্রবীণকে রেখে উক্ত প্রবীণের পুত্রবধূর নির্লিপ্ত সৌন্দর্যচর্চা, শাশুড়ি-বউয়ের টিভির সিরিয়ালপ্রীতি, বাবার সম্পত্তি কবজাকরণের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ের কলকাঠি নাড়ানো প্রমাণ করে স্যুট-টাই কিংবা করপোরেট ঝাঁ চকচকে পলিশ জুতার ভেতরে কী এক যা তা মনোবৈকলের উন্মাদ গন্ধমূষিকের গোপন আবাস!

‘মৎস্যজীবন’ও যেন তেমনই এক আধুনিক জীবনের চাকচিক্যময় স্খলনের আভাস! বাহ্যিক সৌন্দর্য, স্থূল আনন্দলাভের মোহে কী সাবলীলতায় দুটি বিবাহিত নর-নারী নিষিদ্ধ এক সম্পর্কের দিকে ক্রমে এগোয়। বাস্তব পরিবেশ-প্রতিবেশের সমীকরণে যেখানটায় গিয়ে এসব অপাঙ্‌ক্তেয় সম্পর্কগুলো নিঃশেষিত হয়, সেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আগেই ফিরে আসার যে ‘ইউটার্ন’, তা পাঠকের নৈতিক বোধকে জাগ্রত করবে। পরকীয়ার মতো সামাজিক ব্যাধিতে জড়াতে গিয়ে আর জড়ানো হয় না, চরিত্র দুটো ফের ফিরে যায় আপন ঘরে। ‘লিখতে না পারার গল্প’ এ গল্পকার কিছু না লিখেও অনেক কিছু লিখে ফেলেছেন বলেই এ গল্প পড়ে জানা যায়, অ্যাসিডাক্রান্ত একটি মেয়ের মনোদৈহিক ক্ষত ও তার যন্ত্রণার কথা!

এ ছাড়া বইটির অন্যান্য গল্প যেমন, ‘একটা কুকুর অথবা একজন কবির গল্প,’ ‘ভ্যাদা কবির প্রস্থান কবিতা,’ ‘জীবনটা গল্পের অথবা মরীচিকার’ কিংবা ‘একবার যদি কথা হতো’ যাপিত জীবনের অব্যক্ত কথাই কয়। প্রাক্‌-আধুনিক যুগেও মানুষের অসুখের ক্ষতে ড্রেসিং করার সুখ-সুখ গজের ব্যান্ডেজ মোড়া কৃত্রিমতা ছিল না। অথচ এই উত্তর-আধুনিক যুগে এসে মানুষ তার ব্যক্তিপরিচয় সংকট, স্বীকৃতির সংকট কিংবা অপ্রাপ্তিকে মেকি উদ্‌যাপনে ঢাকার মতো প্রকাশ-সংকটকে নিরূপিত করে। খ্যাতিপ্রাপ্তির লোভে বিদেশ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিলেতি কুকুরের বন্দনা করতে গিয়ে যখন দেশি কুকুরের মাহাত্ম্যের কাছে হার মানে, তখনই বোঝা যায় অস্তিত্বের সংকটটা ঠিক কোনখানে। ‘একটা কুকুর অথবা একজন কবির গল্প’ সেই সংকটেরই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। ‘জীবনটা গল্পের অথবা মরীচিকার’ গল্পটি যে আবহে গড়ে উঠেছে, তা এক হাহাকারের গল্প। সন্তান লাভের তীব্র হাহাকার। ‘একবার যদি কথা হতো’ গল্পটি যদিও কৈশোরের প্রথম প্রেমের অপ্রকাশিত অনুভূতিকে প্রকাশ করে, তবু তাকে অস্বীকার করতে পারবে না কেউই; না প্রৌঢ়, না ষাটোর্ধ্ব। তাই গল্পটি যেন প্রতিটি মানুষের কমন একটি গল্প।
গল্পগ্রন্থটির শরীরজুড়েই যেন অতীতের বাজারে জমাট এক সওদাপাতি। বইটি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়। বইটির প্রকাশক বেহুলা বাংলা। আগে হাতে আসে। বইটিতে ঠাঁই পাওয়া প্রায় সব গল্পই উত্তম পুরুষে বর্ণিত। গল্পের অবয়ব নির্মাণে আরও কৃচ্ছসাধন করা যায় কি না, তা নিয়ে গল্পকার আরেকবার ভাবতেই পারেন।