পাঠচক্র মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে পাঠচক্রের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁদের কথা শুনেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মেহেরাব হোসেন

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বনমায়াতে শিক্ষার্থীদের পাঠের আসর। প্রতীকীছবি: অদিত আল নাফিউ

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে পাঠচক্রের বিকল্প নেই। পাঠচক্র এমন এক আড্ডা, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা একসঙ্গে বসে নানাবিধ বিষয়ের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেদের আবিষ্কার করেন। উঠে আসে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, রাষ্ট্র, ধর্মের মতো নানাবিধ বিষয়। এসব বিষয় নিয়ে হয় যুক্তিতর্ক, জ্ঞানের আদান-প্রদান।

পাঠচক্র মানুষকে স্বশিক্ষিত করে তোলে। বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন ঘটায়। ভাবতে শেখায় ভিন্নভাবে। নিজেকে উপস্থাপন, অন্যকে ধারণ করা থেকে শুরু করে সৃজনশীলতা, সহনশীলতা, রুচিশীলতা বাড়ায় বহুগুণ। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাঠচক্রের আয়োজন করতে পারলে শিক্ষার্থীরা সিলেবাসের বাইরের আরও অনেক বিষয় সম্পর্কেও জ্ঞানার্জন করতে পারবেন।

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পাঠচক্র
বই জ্ঞানের খোরাক। বই মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, ভাবায়। ডুবুরি যেমন গভীর সমুদ্রে মণিমুক্তা আহরণ করে, তেমনই বই পাঠককে জ্ঞানের গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে সাহায্য করে। আর বইপাঠের পর যদি পাঠচক্রের আয়োজন হয়, সেই বই আলোচনা তখন জ্ঞানের বিকাশকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করে। সুশৃঙ্খল, বিনয়ী, সহনশীল, আলোকিত সমাজ গঠনে পাঠচক্রের প্রসার জরুরি। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল মানুষ তৈরি হয়, অন্যদিকে আলস্য কাটে, মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা দূর হয়। একটি পাঠচক্রে একে অন্যের মধ্যে যে হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়, তা অন্য উপায়ে সম্ভব নয়। তাই সুন্দর, সৃজনশীল, রুচিশীল ও মানবিকবোধসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে নিয়মিত বইপাঠ ও পাঠচক্র আয়োজনের বিকল্প নেই।

মারুফ হোসেন
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠচক্র মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়
পাঠচক্র এমন একটি বিষয়, যেটির মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় সম্ভব হয়; যা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। এ ছাড়া এতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলগত কাজের দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সমালোচনামূলক ভাবনার আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিশেষ করে কোনো পাঠক যখন একটি বই বা লেখা পড়ে, সিনেমা দেখে, ভ্রমণ করে বা যেকোনো বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করে এবং অন্যের মতামত শোনে, তখন তার বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তির বিস্তর বিকাশ ঘটে। বুদ্ধির নতুন নতুন আঙ্গিক তৈরি হয়। তেমনই ক্যাম্পাসগুলোতে পাঠচক্রের আয়োজন শিক্ষার্থীদের প্রাসঙ্গিক জ্ঞানকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে, যা তাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পেশাগত জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

রিয়া আক্তার
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠচক্র পাঠাভ্যাস তৈরি করে
আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখি। সেই ব্যস্ততার জায়গা বইকে ঘিরে হলে মন্দ হয় না। বই ঘিরে গড়ে তোলা জ্ঞানের প্রাচীরের অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্য মেলে পাঠচক্রে। পরিচিত আলোচনার মধ্যেও যেন নতুনত্ব খুঁজে পাই। একটি বই পড়ে কয়েকজন মিলে আলোচনা করলে আমাদের চিন্তাচেতনাগুলো জানা যায়। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা পড়ুয়াদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হয়। নানা মুনির নানা মত থেকে আমরা আমাদের চিন্তার প্রসারতা তৈরি করতে পারি। মেলে ধরতে পারি সম্ভাবনার ডালপালা। পাঠচক্রের মাধ্যমে সমাজে এমন কিছু মানুষ তৈরি করা সম্ভব, যারা সৃজনশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, রুচিশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সমাজে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

তৈয়বা খানম,
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

পাঠচক্র অন্যের মতামত শোনার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ক্যাম্পাসে নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের বিস্তৃতি ও চিন্তাভাবনা প্রসারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে যেমন জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, তেমনই কোনো বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা ও ব্যতিক্রম চিন্তাও জাগ্রত হয়। পাঠচক্রে অনেক শিক্ষার্থী উপস্থিত থেকে যে যার মতো করে সুশৃঙ্খলভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করে। এতে একদিকে যেমন কথা বলার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে অন্যের কথা শোনার এবং অন্যকে বলতে দেওয়ার মনমানসিকতা সৃষ্টি হয়। তাই বলা যায়, পাঠচক্রের মাধ্যমে মানুষের যোগাযোগদক্ষতা বাড়ে, আবার দলগত কাজ করার প্রবণতাও বাড়ে। আমাদের উন্নত মনমানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে ক্যাম্পাসগুলোতে নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি।

সানজিদা ইয়াসমিন
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠচক্রে ভিন্নমতের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়
বই মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। জ্ঞানীরা মানুষকে বইপাঠে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা সুযোগ পেলেই বই বা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপজুড়ে দিতেন, আসর বসাতেন। এই জ্ঞানের বিনিময় বা মতামত আসরকেই বলা হয় পাঠচক্র। পাঠচক্রে একটি বই সম্পর্কে উপস্থিত সবার মতামত বা অভিজ্ঞতা জানা যায়। একই বই সম্পর্কে একেকজনের কাছ থেকে একেক মতামত, একেক উপলব্ধি বা দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে, যা নতুন জ্ঞান সৃজনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ বইটি পড়ে বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান আহরণ করতে না-ও পারে, পাঠচক্রের মাধ্যমে তা পূর্ণ হয়ে যায়। পাঠচক্রের মাধ্যমে যেমন বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে, তেমনই একে অন্যের মধ্যে একটি আত্মিক উন্নয়ন ঘটে, আন্তরিকতা বাড়ে, সহনশীলতা তৈরি হয়।

ভূঁইয়া শফি
শিক্ষার্থী, মির্জা আজম কলেজ, জামালপুর

প্রতিটি ক্যাম্পাসে পাঠচক্রের মাধ্যমে জ্ঞান বিকিরণের চর্চা হোক
বর্তমান বাংলাদেশে বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞানচর্চার বিকল্প নেই। দেশের বিভিন্ন সংকট নিরাসনে কিংবা সম্ভাবনা তুলে ধরতে প্রয়োজন বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা এবং গবেষণা। শুধু বর্তমানে নয়, এ জন্য যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ প্রয়োজন। পাঠচক্র আমাদের জন্য তেমনই একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। পাঠচক্রে সাধারণত একটা বিষয়ের ওপর কিংবা যেকোনো বিষয়ের ওপর বিভিন্ন ধরনের চিন্তা, যুক্তি বা দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। তখন সেই পাঠচক্রে থাকা মানুষটি যেমন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে পারে, তেমনই অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচেতনার সঙ্গে নিজের চেতনাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে শাণিত করতে পারে। একজন মানুষ যখন বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তার সম্মুখীন হয়, তখন নিজেও যেকোনো বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী গভীর চিন্তা করতে শুরু করে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গবেষণা বিমুখ, তারা তাদের মেধাকে বিকশিত করা নয়, বরং চাকরিকে প্রাধান্য দেয়। শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে প্রয়োজন পাঠচক্রের আয়োজন।

আবু ছাকিব মো. নাজমুল হক
শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ