লাঠির পাঠশালা

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

বয়স তখন পাঁচ কিংবা সাত। অতটুকু জীবনের স্মৃতির পটে একটি দৃশ্য আজও ধূসর হয়নি। মায়ের কোলঘেঁষা বিকেলের সেই মুহূর্ত। বাড়ির সামনের উঠানে মাটিতে বসে আছেন মা, হাতে সুই-সুতা, ব্যস্ত কাঁথা সেলাইয়ে। আর আমি তাঁর ডান পাশে, চুপচাপ বসে আছি। চুপচাপ? হয়তো না। মা আমাকে স্বরবর্ণ শেখাচ্ছেন, কিন্তু আমার মন তখন দূর আকাশের ঘুড়িতে। বাড়ির পাশের মাঠে ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।

পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল না। তবে মায়ের পাশে রাখা সেই লম্বা বাঁশের লাঠিটা আমার কল্পনায় ছিল ত্রাসের প্রতীক। না পড়লে কী হবে, লাঠি তো আছে! সেই ভয়ের কারণেই হোক কিংবা বালকসুলভ দুষ্টামির বশে, একদিন সে লাঠিটা নিয়ে খেলা করতে গিয়ে ঘটিয়ে ফেললাম জীবনের প্রথম দুর্ঘটনা। মনের ভুলে বা সাহসের উন্মাদনায় লাঠিটি মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। মুহূর্তেই লাঠি গলায় আটকে গেল।

মা যেন মুহূর্তেই দুনিয়ার সব আলো হারিয়ে ফেললেন। বিস্ময়ে আর আতঙ্কে জ্ঞান হারালেন। সেই সময়ের কিছুটা স্মরণে আছে, বাকিটা মায়ের মুখ থেকে শোনা। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে মায়ের, আর আশপাশের হুলুস্থুল চিৎকার।

বাবা এসে আমাকে দেখে মুহূর্ত বিলম্ব না করে দৌড়ে গেলেন পাশের ফার্মেসিতে। ওরা জানিয়ে দিল, মেডিকেলে যেতে হবে। মা তখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে এক হাতে আমাকে বুকে চেপে ধরেছেন, অন্য হাতে চোখ মুছছেন। তাঁর কণ্ঠে প্রার্থনার ভারী সুর।
মেডিকেলে নেওয়া হলো। ডাক্তার এলেন। চিকিৎসা শুরু হলো। আল্লাহর রহমতে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম।

এরপর আর কোনো দিন বাড়িতে লাঠি আনা হয়নি। আমারও দরকার হয়নি লাঠির ভয়ে পড়তে বসার। সেই বছরই আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে শুরু হলো এক নতুন যুদ্ধ, প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতা। নিজেকে সবার আগে রাখার সেই আকাঙ্ক্ষা আমাকে বাধ্য করল পড়তে। তখন আর কেউ বলল না পড়ো, না হলে লাঠি আসবে। নিজেই নিজেকে বলতাম পড়তেই হবে, আমাকে প্রথম হতেই হবে!

চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম