শেষ থেকে শুরু

কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচ পয়েন্ট
ছবি: লেখক

সঞ্জয়দার দোকানে বসে চা খাচ্ছি, তবে চা খাওয়াতে মনোযোগ নেই। সঞ্জয়দাকে আরও এক কাপ চা বানাতে বললাম। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। চাপে থাকলে আমার মনোযোগ দূর দেশে বেড়াতে যায়। এমন সময় অভির ফোন। বলে, ‘চল কোথাও বেড়াতে যাই।’ চিন্তায় পড়ে গেলাম, সে কীভাবে আমার মনের কথা বুঝে ফেলল!

আমরা একটি বৈচিত্র্যের পরিধি হিসাব করতে যাচ্ছি, যেখানে থাকবে পাঁচ দিনের একটি বিরতিহীন যাত্রা, বাংলাদেশের চার সীমান্তের জীবনযাত্রার হালচাল, থাকবে আমার-আপনার বৈচিত্র্যকে আপন করে নেওয়ার গল্প। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং থানচি থেকে শিবগঞ্জ এই পাঁচ দিন আমরা ছুটব কিছু গল্প শুনতে…

প্রথম দিন

৮ মার্চ ২০২২, ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন। ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা। অভি এখনো তেজগাঁওয়ের যানজটে। আসতে আসতে প্রায় নয়টা বাজে। স্টেশনের কিছু পথশিশুর দৌড়াদৌড়িতে চোখ আটকে যায়। হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সিনেমা-থিয়েটার মনে হচ্ছে। ১০ টাকার মিনি পেস্ট আর ১ বোতল পানি কিনে উঠে বসলাম ট্রেনের কামরায়। মহানগর এক্সপ্রেসের হুইসেল বাজতে বাজতে রাত ৯টা ৫২ মিনিট। ঠান্ডা পড়ছে মোটামুটি। একটা রংচটা চাদর গায়ে পেঁচিয়ে জানালার পাশে বসি। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বিশ্বযুদ্ধ থামানো যতটা না কঠিন ছিল, তার চেয়ে বড় কঠিন মনে হচ্ছে আমার ছোট্ট ইয়ারফোনের লেগে যাওয়া জট খোলা। হঠাৎ এক বয়স্ক লোক ভাঙা চশমা চোখে তাঁর টিকিট নিয়ে সিট খুঁজতে খুঁজতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেখো তো সিটটা কোথায়?’

সামনের সিটের এক ছোট্ট বন্ধু অভির ইয়ারফোন আর আমার থেকে পাওয়ার ব্যাংক ধার নিয়ে বই পড়ছে। চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর পাঁচটা। স্টেশনে এক কাপ কড়া চা একটা পরোটা দিয়ে ভেজালাম। এটা খাবার রাজনীতি! ভোরের আলো ফোটার আগেই চলে গেলাম নতুন ব্রিজে। চট্টগ্রাম শহরে আসা হলো, কিন্তু ঘুরে দেখা হলো না। কোনো একদিন হবে—এই ভেবে কেরানিহাটের উদ্দেশে বাসে উঠলাম। কেরানিহাট থেকে বান্দরবানের বাসে। সকালের আলো ও কুয়াশা একটু একটু করে পাল্লা দিচ্ছে। বাসে পাশের সিটে এক কাকা আমাদের এ যাত্রার লক্ষ্য শুনে বেশ চিন্তিত। তিনি কোনোভাবেই এটি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর চাকরিজীবন কেটেছে এই বান্দরবানে। বছর দশেক পর এসেছেন সেই সুন্দর দিনগুলো ছুঁয়ে দেখতে। নাশতা করালেন, তারপর আমাদের সুন্দর করে থানচিতে যাওয়ার বাসে তুলে দিলেন।

৪ ঘণ্টার ভয়ানক রোমাঞ্চকর যাত্রা। এত দারুণ রাস্তা আমি সম্ভবত প্রথম দেখেছি। রীতিমতো চোখ ছানাবড়া। পাহাড়ি রাস্তা, ওপর দিয়ে বাস যাচ্ছে, নিচে খাদ। অনেক নাম ভুলে যাওয়া ও উচ্চারণ করতে না পারা পাড়া পেরিয়ে দুপুরে পৌঁছাই দেশের সবচেয়ে পূর্বের উপজেলা থানচিতে। এখান থেকেই আমাদের মাইলফলকের যাত্রা শুরু।

দেশের সবচেয়ে পূর্বের উপজেলা থানচিতে লেখক ও তাঁর ভ্রমণ সঙ্গী
ছবি: লেখক

থানচিতে অধিকাংশ মারমা ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী, যাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। খুব সম্ভবত মারমা শব্দ ‘থাইন চৈ’ বা ‘বিশ্রামের স্থান’ থেকে থানচি নামটির উৎপত্তি। লোককথা অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে বা তার পূর্বে নৌপথে চলাচলকালে যাত্রীরা বিশ্রামের জন্য এ স্থানে থামতেন বলে থাইন চৈ নামে স্থানটি পরিচিতি পায়। পরে তা থানচি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একটু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৮২৪ সালে বার্মা-ব্রিটিশ যুদ্ধের পর থানচি উপজেলা আরাকান ব্রিটিশ-ভারতের প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে থানচি ও এর প্রতিবেশী অঞ্চলে আরাকানিদের অভিবাসনপ্রক্রিয়া বেশ সহজ হয়। অভিবাসীরা এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন।

সাঙ্গু নদীর তীরে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষেরা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করি। এত অল্প সময়ে বোঝা সম্ভব নয় জানি, তবুও মনকে সান্ত্বনা দেওয়া! গ্রামের ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছা, কিন্তু সন্দিহান। শুনেছি, স্থানীয় লোকজন বাইরের মানুষকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। তখন ভাবলাম, কিছু করতে না পারলে এখানে চলে এসে এই নদীর তীরে বাকি জীবন ঘুমিয়ে আর খেয়ে কাটিয়ে দেব!

গোটা থানচিতে প্রধান হাট আছে দুটি—থানচি বাজার ও বালিপাড়া বাজার। দুপুর থেকে আমি আর অভি পুরোপুরি নেটওয়ার্কের বাইরে আছি। এখানে টেলিটক ছাড়া অন্য কোনো সিমে নেটওয়ার্ক পাওয়ার সম্ভাবনা একদম নেই। থানচি বাজারে খাওয়া সারলাম পেট ভরে। এরপর মোটরসাইকেলে করে পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলে গেলাম আলিকদমে। অন্য রকম রোমাঞ্চকর একটা যাত্রা ছিল, যা আসলে এই রিদমিক কি-বোর্ড দিয়ে টাইপ করে বোঝানো সম্ভব নয়। মাঝে পড়ল ডিম পাহাড়। এর আগে হয়তো নিজেকে এতটা মুক্ত আর হালকা মনে হয়নি। জাগতিক সব ভয় খুব তুচ্ছ আমার কাছে। মাঝে দুইবার চেকপোস্টে থেমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ফটোকপি দেখাতে হয়েছে।
আলিকদমে এসে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়। মোটরসাইকেলচালক সিরাজ ভাই। তাঁর সঙ্গে চা খেলাম আলিকদম বাজারে। গল্প হলো তাঁর জীবিকা ও জীবনদর্শন নিয়ে। চান্দের গাড়িতে চেপে বসলাম চাকুরিয়ার উদ্দেশে। ঝাঁকুনি খেয়েটেয়ে দেড় ঘণ্টার লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে দেখি, কক্সবাজারের বাস দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১০টা। সুগন্ধা বিচ পয়েন্টের পাশের একটি হোটেলে রাতে আশ্রয় নিলাম। মধ্যরাতে একটা হাফ আর একটা কোয়াটার তেহারিতে পেট ভরে সুগন্ধা বিচ পয়েন্টে সমুদ্রের গর্জন শুনি। চারদিকে অদ্ভুত শূন্যতা!

দ্বিতীয় দিন

ভোরে সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছা থাকলেও ঘুম না ভাঙায় সেই সৌভাগ্য হয়নি। কক্সবাজারে হোটেল থেকে চেকআউট করতে করতে সকাল সাড়ে ১০টা। এক কাপ কালিজিরা দিয়ে চা, আর হাতে একটা শিঙাড়া নিয়ে ডলফিন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। গন্তব্য এবার টেকনাফ। সাম্পান গাড়িগুলো মেরিন ড্রাইভ হয়ে টেকনাফ যায়। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে এক দফা গল্প করে নিলাম গফফার ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি অমায়িক মানুষ, হোটেল ব্যবসায়ী। টেকনাফ অবধি সঙ্গে না গেলেও পরে দুইবার ফোন দিয়ে রাতে তাঁর বাসায় আতিথেয়তা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে সমুদ্র। একটা কথা বলে নিতে হয়। বাড়ি থেকে ফ্যান কেনার জন্য টাকা পাঠিয়েছিল, সেটা দিয়ে এই ভ্রমণ। মেরিন ড্রাইভের শীতল হাওয়া গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্যানের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। সাবরাং নেমে টেকনাফ বিচ। সেখানে গিয়ে স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক মাছ ধরলাম। কখনো বণিক হয়ে এই ঘাটে নোঙর ফেলার বাসনা জাগে। অন্যদিকে অভি ঝিনুক কুড়াতে ব্যস্ত। একটি নিস্তব্ধ সমুদ্রসৈকত, কিছু জীবিকাসংগ্রামী মানুষ, আর পাড়ে পড়ে থাকা মৃত শামুক। গত এক বছর ধারাবাহিকতায় আবদ্ধ দর্শন নিয়ে প্রবহমান একটি মস্তিষ্ককে নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখানোর জন্য এতটুকু যথেষ্ট।

টেকনাফ জিরো পয়েন্টে লেখক (বামে) ও তাঁর ভ্রমণ সঙ্গী
ছবি: লেখক

অটোরিকশায় করে টেকনাফ জিরো পয়েন্ট। দুপুরে খেলাম বেলাম্বার (ছোট টাইপের টমেটো) টক আর হাইচ্চান (অনেম রকম সিম দিয়ে রান্না তরকারি)। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে টেকনাফের খাবারের স্বাদ একটু ভিন্ন। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী জনপদের রয়েছে স্বকীয়তা। টেকনাফ উপজেলায় অনেকগুলো হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ বাজার, সিকদারপাড়া বাজার, সাবরাং নোয়াপাড়া বাজার, হ্নীলা বাজার, শাহপরীর দ্বীপ বাজার, শামলাপুর বাজার, টেকনাফ সদর বটতলী বাজার, হোয়াইক্যং বাজার উল্লেখযোগ্য।
উদরপূর্তি সেরে টেকনাফ থানার পাশে মাথিনের কূপে গেলাম। কূপটি একটি অসমাপ্ত প্রেমকাহিনির ধারক, যেখানে মাথিন নামের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করে। গোটা বিষয়টি একটি কট্টর মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে বার্মা পাড়ার দিকে। নাফ নদীতে গিয়ে নিজেকে সমাজতান্ত্রিক হিসেবে দাবি করতে মন চাচ্ছে। এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে নদী, মাঝবরাবর আমরা উড়ছি। সেটাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল দিনের শেষ সূর্যকিরণ, যেন তার সব তেজ আমাদের ভেতর ঢেলে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে। এটি ছিল আমাদের দ্বিতীয় মাইলফলক।

কক্সবাজার জেলার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে উখিয়া ও টেকনাফের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীটি। এটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানা নির্ধারণকারী পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের নদী হিসেবে পরিচিত। মূলত এটি কোনো নদী নয়, বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ। এ কারণে পানি লবণাক্ত। এ নদীর পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা এবং পূর্ব পাড়ে বার্মা ও আরাকান প্রদেশের আকিয়াব অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে শাহপরীর দ্বীপ নাফ নদীর মুখে অবস্থিত এবং বর্মি-ইংরেজ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাফ নদীর পাড়ে রয়েছে চিংড়ি প্রকল্প, লবণমাঠ। আরও রয়েছে কেওড়াবাগান, বাইনবাগানসহ জীববৈচিত্র্যের বিপুল সমাহার।

টেকনাফ সমুদ্র সৈকত
ছবি: লেখক

বার্মা পাড়ায় গিয়ে যেটি নতুন ছিল, সেটি লবণ চাষ দেখা৷ জব্বার ভাই ও জামিউল ভাইয়ের বাড়ি কুতুবদিয়ায়। বছরের এ সময় লবণ চাষ করতে আসেন এখানে আর বর্ষাকালে ধরেন মাছ। তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন লবণখেত। জব্বার ভাই সময়বাদী জীবিকা নির্বাহ করেন, যখন যেখানে যেটা।

সন্ধ্যাবেলা বাজারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি বাসস্ট্যান্ডে। টেকনাফের মানুষদের দেখতে বেশ অন্য রকম। নিজেদের ব্যাক প্যাক নিয়ে কিঞ্চিৎ বিদ্‌ঘুটে লাগছে। অভি খেল চিনির জিলাপি, আর আমি গুড়ের জিলাপি। বাসস্ট্যান্ডে এসে শেষ বাসে উঠে বসলাম। পাওয়ার ব্যাংকটা লাগিয়ে চাদর মুড়ি দিলাম।

বন্ধু, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা