শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিধ্বনি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’

‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র একটি দৃশ্যে ববিতা
ববিতা যদি দোয়েল হয়, তারানা তবে বাংলাদেশের শাপলা। আর গোলাপীর মায়ের চরিত্রে কিংবদন্তী রোজী সামাদ তো অনন্য, অভিনয়ের সৌন্দর্যে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে অনবদ্য জুটি।

শহুরে অল্প বয়সী মেয়েদের সিগারেট খেতে দেখলে এখনো অনেক পুরুষের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। যেন কী না কী দেখছে! নারী হোক বা পুরুষ, ধূমপান সবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব জেনেও পুরুষ যদি সিগারেটের সুখটানে ধোঁয়া ওড়াতে পারে, সিগারেট টেনে সিনেমার নায়কোচিত ইমেজ ফলাতে পারে, একজন সচেতন নারী সিগারেট খেলে ক্ষতি কোথায়?

আবার যে কলেজপড়ুয়া মেয়েটি বা কোনো নারী কবি, শিল্পী, লেখক, ডাক্তার ও সাংবাদিককে সিগারেট খেতে দেখলে যে পুরুষকুলের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সমাজের নিম্নবিত্তের মানুষ নারী শ্রমিকেরা বিড়ি খেতে দেখলে কারও কিন্তু চোখে লাগে না। যেন এটা চোখে সয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়! গ্রামাঞ্চলে ছোটবেলায় আমার ঠাকুমা-দিদিমাদেরও বিড়ি খেতে দেখতাম। আমজাদ হোসেন ১৯৭৮ সালে নির্মিত তাঁর কালজয়ী ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে গোলাপী, ময়না, বুড়িদের মতো নারী শ্রমিকদের কিন্তু বিড়ি খেতে দেখিয়েছেন। যেকোনো শিল্পমাধ্যমই জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমরা চারপাশে চলমান যা কিছু দেখি, তা নিয়েই তো চলচ্চিত্র। ববিতা, আনোয়ারা, রওশন জামিলের মতো কিংবদন্তী শিল্পীরা পরিবেশ–পরিস্থিতির চাপে গ্রাম থেকে আসা ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকের চরিত্রে এই চলচ্চিত্রে এত সুন্দর অভিনয় করে গেছেন, দেখে মনে হয়েছে কবি জয় গোস্বামীর কবিতার লালগোলা বনগাঁর ট্রেনে চাল তোলা মাসি–পিসিদের সঙ্গে ওদের কোনো পার্থক্য নেই। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা, দেশ, কাল ও স্থানবিশেষে প্রায় একই। আর পাত্রটি যদি নারী হন, পদে পদে শরীর তার শত্রু। তার কোনো মন, ব্যক্তিত্ব থাকতে নেই, শুধুই একটা ভোগ্যপণ্য শরীর। ঘরে, পরিবারে স্বামীর লাথি ঝাঁটা খায়, গ্রামে মোড়লের কুচক্রান্ত মাতব্বরির শিকার হয়, শহরে স্টেশনে এসে পুলিশের লাঠি খেতে হয়। টিকিট বাবুর চোখ এড়িয়ে চলতে হয়। ব্যবসার ময়দানে নারীদের জন্য আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কত রকমের ফন্দিফিকির কূটনীতি।

আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের ব্যতিক্রমীদের মধ্যেও ব্যতিক্রমী পরিচালকদের একজন। পরিচালকদের শিক্ষক। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন, আলমগীর কবীর, তারেক মাসুদের মতো পরিচালকেরা ছিলেন বলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিশ্বনন্দিত হয়ে উঠেছে। এই পরিচালকেরা ছিলেন একাধারে সুলেখক এবং গভীর সমাজমনস্ক দার্শনিক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমজাদ নিজের ‘ধ্রুপদী এখন ট্রেনে’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। বাস্তবেই এই চলচ্চিত্র কালজয়ী ও ধ্রুপদী ঘরানার।

চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা, ‘আছেন আমার মোক্তার/আছেন আমার ব্যারিস্টার/শেষ বিচারের হাইকোর্টেতে/তিনিই আমায় করবেন পার...’ এবং ‘হায়রে কপাল মন্দ/চোখ থাকিতে অন্ধ/এই জীবন জ্বইলা পুইড়া/শেষ তো হইল না...’ এই দুটি গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। প্রথম গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আলাউদ্দীন আলীর সুরে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। চলচ্চিত্রে কবিয়াল গোলাপীর বাবা আনোয়ার হোসেনের অনবদ্য অভিনয়ে এই গান প্রাণ পেয়েছে। গোলাপী, আলাপী দুই কন্যা এবং সংসারের ঘানি টানা স্ত্রীকে সময় না দিয়ে গান–পাগল কবিয়াল শুধু মাঠেঘাটে পাড়ায় পাড়ায় গান করে বেড়ায়। গোলাপী ববিতার পাশে আলাপী তারানা হালিমকেও এই চলচ্চিত্রে সুন্দর মানিয়েছে। দুজনে মিলে যখন ঠোঁটে রং লাগাচ্ছিল, পায়ে আলতা দিয়ে রাঙিয়ে তুলছিল বেশ সুন্দর লেগেছে। এখন কর্মব্যস্ত জীবনে খুব কম মেয়েরা নাকে ঝোলানো নোলক পরে। তারানার নাকের নোলক তার গোটা মুখটাকে আলোকিত করেছে। ববিতা যদি দোয়েল হয়, তারানা তবে বাংলাদেশের শাপলা। আর গোলাপীর মায়ের চরিত্রে কিংবদন্তী রোজী সামাদ তো অনন্য, অভিনয়ের সৌন্দর্যে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে অনবদ্য জুটি।

গ্রামের মোড়ল জমিদার এটিএম শামসুজ্জামান অন্য এক প্রভাবশালী বিত্তবানের ছেলের সঙ্গে গোলাপীর বিয়ে ঠিক করেছিল। মোড়লের ছেলে মিলন অভিনয়ে ফারুক; কিন্তু মনে মনে গোলাপীকে ভালোবাসত। বিয়েতে যৌতুক ধার্য হয় বরের জন্য একটা সাইকেল। কবিয়াল মোড়লের কাছে জমি বন্ধক রেখে সাইকেলের টাকা জোগাড় করতে যায়। মনের মানসীকে হারানোর ব্যথার মধ্যেও মিলন গোপনে সেই সাইকেল কেনার টাকা গোলাপীর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা কিন্তু হয় না। বরযাত্রী অপমান করে ফিরে যাওয়াতে কবিয়াল আত্মহত্যা করে। দুই কন্যা আর স্ত্রীর বুকফাটা ক্রন্দনের মধ্য দিয়ে কবিয়ালের লাশ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ‘সেদিনের সেই ইস্টিশনে/থাকবে নানান প্যাসেঞ্জার/দ্রুতযানে পার হবে সে/টিকিট কাটা আছে যার’। সেই বিখ্যাত গান আবার আবহে বাজতে থাকে। বাংলার নদী, মাঠ, ঘাস, ফুল গানের সুরে যেন বুক ডুকরে কেঁদে ওঠে। অসাধারণ মুনশিয়ানায় এই দৃশ্যগুলো আমজাদ বুনেছেন।

দ্বিতীয় জনপ্রিয় গান ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ…’ লিখেছেন পরিচালক নিজে। চলচ্চিত্রে শুটিং চলাকালে ট্রেনে যাতায়াত করার সময় ববিতাসহ সবাই কালো চশমা পরেছিলেন। তখন নাকি হঠাৎ আমজাদের মাথায় আসে ববিতার কণ্ঠে একটা গান রাখতে হবে। সবার চোখে কালো চশমা দেখে এই গানের কথাগুলো হয়তো মনের মধ্যে ভেসে এসেছিল। গোলাপী, ময়না আর বুড়ি যখন বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়েছে। রোজ খেটেখুটে লাভ হয় দুই টাকা, সাত টাকা দিয়ে টিকিট কাটবে কী করে? এদিকে টিকিট চেক করতে টিটি পুলিশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধরা পড়লে রক্ষা নেই। মোবাইল কোর্ট থেকে বাঁচার জন্য গোলাপী অন্ধ সেজে এ গানটি গেয়ে ওঠে। দার্শনিক আমজাদের ভাবনার অন্য একটি বিখ্যাত সংলাপও ট্রেনে যাতায়াত করার সময় গোলাপীর মুখে উঠে আসে। উচ্চ শ্রেণির অভিজাত যাত্রীরা যখন নিম্নবর্গের গোলাপীদের একই কামরায় দেখে ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে, গোলাপী বলে ওঠে, ‘বাংলাদেশে কোনো কেলাস নাই গো, আমরা হগলেই এক কেলাসের মানুষ’।

অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার পরেও সীতাকে যেভাবে পাতালে প্রবেশ করতে হয়, গোলাপীদের মতো ট্রেনে ঘুরে বেড়ানো নারীদের চরিত্র নিয়ে গ্রামের মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করে। ভালো চোখে দেখে না। গ্রাম থেকে নির্বাসিত হয়ে জীবিকার লড়াইয়ে তাই ট্রেনেই ফিরে যেতে হয়।

এই যে শ্রেণিসত্তা, শ্রেণি বিভাজন, বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়ার চরম মাৎস্যন্যায়, সামাজিক এই শোষণ–বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রবল শ্রেণিসংগ্রাম একসময় অবধারিত হয়ে ওঠে। যে গোলাপী এবং অন্যদের জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে কাহিনি ডালপালা মেলছিল, শেষে গিয়ে পরিচালক মূল বক্তব্য মিলন চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে আনেন।

মোড়লের ছেলে মিলন একসময় ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকা গ্রামের সব শোষিত–নিপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। নিজের বাবাসহ অন্য সব মোড়লের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দেয়। আর নিজেদের ক্ষমতা জারি রাখার জন্য সব মোড়ল মিলে মিলন পাগল হয়ে গেছে চারদিকে রটিয়ে দিতে শুরু করে। মিলনের বাবা ছেলেকে শিকলে বন্দী করে রাখে। শিকলে বন্দী মিলনের মধ্য দিয়ে গোটা পৃথিবীর ক্রীতদাসদের ছবি উঠে আসে। মিলন হয়ে ওঠে বন্দী প্রতিবাদীদের মুখ। নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাগরণের ধ্বনি এবং শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিধ্বনি যেন এই চলচ্চিত্র। যেভাবে জেলখানার ভেতরে প্রতিবাদীদের পিটিয়ে মারা হয়। নতুন দিনের নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে গুম করা হয়। সব মোড়ল মিলে মিলনকেও বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে।

যে মা ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধরে মিলনকে জন্ম দিয়েছে, সেই মা মোড়লদের ফন্দি বুঝতে না পেরে ওষুধ ভেবে নিজের হাতে বন্দী ছেলেকে বিষ খেতে দেয়। ফারুকের অভিনয় এই পর্যায়ে এসে বিশ্ব চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের সমপর্যায়ের হয়ে ওঠে। ফারুক-ববিতা জুটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শিখর ছোঁয়া, গগনচুম্বী ইতিহাস। মিলনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ হয়তো মরে না; কিন্তু শোষিত–নিপীড়িত মানুষের মৃত্যু যে এভাবেও অবধারিত থাকে, সেই কলঙ্কিত ইতিহাস উঠে আসে। আবার মিলনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুক্তির ডাক ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মার খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। রক্তের বদলে রক্ত, হত্যার বদলা হত্যার মধ্য দিয়ে মোড়লদের আগ্রাসনের রাজনীতি শেষ হয়। এ ছাড়া যে নিম্নবর্গের মানুষের মুক্তির অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। ওরা কাউকে মারতে চায়নি। গ্রামে সবাই সুখে–শান্তিতে বাস করতে চেয়েছে। সেই সমাজব্যবস্থাটাকে মোড়লেরা নষ্ট করে ফেলেছিল।

শেষ পর্যন্ত তবে কি শুধু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা বলে এই চলচ্চিত্র? না, তা নয়। রণ রক্ত সফলতার সত্যও শেষ সত্য নয়। ছোট ছোট মানুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম, নিত্যদিনের দুঃখ-কষ্ট যাপনের মধ্যেও ছোট ছোট ভালোবাসার মুহূর্ত উঠে আসে। কবিয়ালের বড় দুঃখ ছিল বউ তার সুর করে গাইতে পারে না। কথায় কথায় কাব্যগীতি ধরতে পারে না। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়। সেই বউ তবু ভাত রাঁধে, স্বামী আর মেয়েদের পরম মমতায় খেতে দেয়। স্বামীর রাগ ভাঙাতে স্ত্রী, সুরে কথা বলে ক্ষমা চেয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে। আর তখনই বাবা আর দুই মেয়ে মিলে গেয়ে ওঠে, ‘ওরে তোর মা জননী আমার সাধের খঞ্জনি/সুরের গলায় লইটকা আছে যেন অসুরের বন্ধন...’। সাবিনা ইয়াসমিন, আব্দুল হাদীর কণ্ঠে এ গানটিও চমৎকার। আলাউদ্দীন আলীর সুরের সঙ্গে রফিকুল বারী চৌধুরীর চিত্রগ্রহণও চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আর কাহিনির নামকরণের আক্ষরিক সত্যটিও উঠে আসে শেষ দৃশ্যে। অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার পরেও সীতাকে যেভাবে পাতালে প্রবেশ করতে হয়, গোলাপীদের মতো ট্রেনে ঘুরে বেড়ানো নারীদের চরিত্র নিয়ে গ্রামের মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করে। ভালো চোখে দেখে না। গ্রাম থেকে নির্বাসিত হয়ে জীবিকার লড়াইয়ে তাই ট্রেনেই ফিরে যেতে হয়। গোলাপীরা আসলে কাঁটায় ফোটা গোলাপ। গোবরে ফোটা পদ্মফুল। ট্রেন রূপক অর্থে এখানে চিরকালের লড়াকু শ্রমজীবী মানুষের যাত্রাপথ।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত