রহস্যময় নারী

অলংকরণ: এসএম রাকিবুর রহমান

ছোটবেলা থেকে মুনিয়ার বাবা একটা কথা বলত, ‘ভাবনায় ভাবনা বাড়ে। অত ভেবে কে কী করেছে কবে? তাই ভাবনা ছাড়। বিন্দাস কাজ করে যা!’ তবে মুনিয়া সেসবে কান দেয় না। সে প্রচুর ভাবে; পড়াশোনা, চাকরি, দেশ—এসব নিয়ে। এমনকি মহল্লার ধূসর রঙের বিড়ালটির একদিন দেখা না পেলেও ভাবে, দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। নিমেষেই সে ভাবনার জগতে হারিয়ে যেতে পারে।

সপ্তাহখানেক আগের কথা। মুনিয়া সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাচ্ছিল, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে। ট্রাফিক জ্যামে বসে ভাবছে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে কী করবে। পাটিগণিতের দুইটা অধ্যায় এখনো বাকি, সামনেই একটা মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক পদের চাকরি পরীক্ষা। মুনিয়া জানে, জীবন সহজ নয়, আবার কঠিনও নয়। অনেক বড় হতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ট্রাফিক বাতি লাল থেকে সবুজ হয়েছে, খেয়াল করেনি সে। তীব্রগতিতে পেছন থেকে আসা একটা মোটরসাইকেল মুনিয়াকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। মুনিয়া রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। মধ্যবয়সী এক নারী সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। মুনিয়াকে ধরে রাস্তার এক পাশে নিয়ে গেলেন। ‘তুমি ঠিক আছ, মা?’ ‘জি, ঠিক আছি।’ ‘কাছেই ডাক্তারের চেম্বার আছে। চাইলে ওখানে দেখিয়ে যাও।’ ‘না, না, আন্টি। তেমন কিছু হয়নি। শুধু একটু কেটে গেছে। ব্যাগে ব্যান্ডেজ আছে, লাগিয়ে নেব।’

ভদ্রমহিলা মুনিয়ার কথা শুনে মৃদুস্বরে হাসলেন। ‘হাসছেন যে...’। ‘আমি আগে ঠিক তোমার মতোই ছিলাম! দেখলে মনে হবে শান্ত, কিন্তু ভেতরে রাজ্যের অস্থিরতা।’ ‘বুঝিয়ে বলুন।’ ‘সব কথা বুঝতে নেই। সব বিষয়ে ভাবতে নেই।...থাক, আজ বরং আসি। যদি আবার দেখা হয়, তখন বাকিটা বলব।’ উত্তরের অপেক্ষা না করে মহিলাটি দ্রুতগতিতে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। মুনিয়া তাঁর হেঁয়ালিময় কথার কিছুই বুঝতে পারল না।

সেদিনের পর থেকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। মুনিয়া তার আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ করল। সে আর আগের মতো ভাবতে পারে না। কোনো কিছু গভীরভাবে ভাবতে গেলেই আবার ভাবনার শুরুতে এসে দাঁড়িয়ে যায়, যেন ওর চিন্তার জগতের সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেছে। এই সীমানা কোনোভাবেই পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে না।

আজ অফিসে দেড় ঘণ্টা মিটিংয়ের পর মতামত জানতে চাইলে মুনিয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করেও কিছু বলতে পারল না। অথচ আগে মুনিয়া পয়েন্ট ধরে ধরে ব্যাখ্যা দিত। কিন্তু আজ ওকে নির্বিকার দেখে অফিসের সবাই অবাক হলো।

মুনিয়া বাড়ি ফিরে দেখে মা ওর জন্য সন্ধ্যার নাশতায় পাস্তা তৈরি করেছে। মুনিয়া দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে এক কাপ চা আর পাস্তা নিয়ে বসল। টেলিভিশনে সন্ধ্যা সাতটার সংবাদ চলছে। যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি। এ নিয়ে চারদিকে তুমুল আলোচনা!

কিছুক্ষণ পর রেহেনা বেগম এসে মেয়ের পাশে বসে। মুনিয়া টেলিভিশন বন্ধ করে মায়ের কথা শোনায় মনোযোগ দিল। ‘কিরে! কী হয়েছে তোর? অন্য সময় তো অফিস থেকে ফিরে সারা দিন কী কী হলো বলিস, কদিন হলো আর বলিস না। ঘরের মানুষের সঙ্গেও কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিলি!’

‘মা কখনো কি এমন হয়েছে যে যা ভাবতে চাইছ তা আর ভাবতে পারছ না? তখন মনে হয় সব ভাবনা চুরি হয়ে গেছে।’ ‘আমাদের ভাবনা তো কবেই চুরি হয়ে গেছে। এখানে মন খুলে বলতে মানা, যা জানি তা জানাতে মানা।’ মায়ের জবাব।

‘আমি তা বলতে চাইনি। বিষয়টা মনস্তাত্ত্বিক। আমি হয়তো বোঝাতে পারছি না কী বলতে চাই।’ মুনিয়া নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। ‘মানুষের ভাবনার জগৎ বড় জটিল। তবে মানুষ অত জটিল নয়। সে আজীবন তার ভাবনার রহস্যময় জগৎ নিয়ে অন্য মানুষের কাছে ব্যাখ্যা দেয়, ব্যাখ্যা শোনে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যার কোনো শুদ্ধতার পরিমাপক নেই।’ রেহেনা বেগম একনাগাড়ে বলে গেলেন। মুনিয়া ওর মায়ের কথা শুনে চুপ করে আছে। মা যে আগে কখনো এমন গুরুগম্ভীর কথা বলেনি। হয়তো মনে অনেক কথা জমে আছে। আচ্ছা, যেসব কথা কখনো শোনা হয়নি, সেসব কথা কি একসময় হারিয়ে যায়। মুনিয়া ভেবে পায় না।

অনেক রাত পর্যন্ত না ঘুমিয়ে বারান্দার কোণে চেয়ার পেতে বসে রাতের আকাশ দেখছে মুনিয়া। আকাশে আজ তারা নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার; যেমন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে মুনিয়ার ভাবনার জগৎ। সে আগে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করত। আর এখন কী বলবে তা ভাবতে ভাবতেই সময় পেরিয়ে যায়। আগে রাস্তায় রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে যাত্রীরা ভাড়া নিয়ে কথা–কাটাকাটি করতে দেখলে এগিয়ে যেত, বাসে নারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার হতে দেখলে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাত; এখন নীরব থাকে। মুনিয়া বেশ কয়েক দিন ধরে রাস্তায় দেখা হওয়া সেই রহস্যময় নারীকে খুঁজছে!

রমনা, ঢাকা