‘প্রতিরোধক্ষমতাবিহীন অসহায় মানুষদের হত্যা করতে পারা যদি সাফল্য হিসেবে গণ্য হয়, তবে ওই জঙ্গি বিমানের চালকেরা সফল হয়েছেন নিঃসন্দেহে।’
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজের লেখা ‘যুদ্ধদিনের কথা’ বইয়ে এ কথা বলেছেন জিম ম্যাকিনলে। মার্কিন এই নাগরিক খ্রিষ্টান মিশনারিজের কাজে তখন বাংলাদেশের ফেনীতে পরিবারসহ বসবাস করতেন। তাঁর বাড়িতেও পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে হামলা চালানো হয়।
‘যুদ্ধদিনের কথা’ গ্রন্থটিতে ম্যাকিনলের ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ফেনীতে আঘাত হানলে, সেই সময় থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কার দুঃসহস্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন।
তাঁদের মাথার ওপর যুদ্ধবিমান, ঘরের আশপাশে বোমার আঘাত, ওত পেতে থাকা মৃত্যু—এত কিছুর পরও ৩০ লাখ বাঙালির মতো বিজয়ের অপেক্ষায় থেকেছেন।
তথ্যবহুল বাস্তব ঘটনার অবলম্বনে রচিত এই গ্রন্থ থেকে বিশেষ কিছু লাইন উল্লেখ করছি—
‘আমিও স্বাধীনতা চাই। কিন্তু মনে হচ্ছে, আমি ভালো যোদ্ধা হতে পারব না।’ (ম্যাকিনলেকে এক তরুণী বলেছিল; যে কিনা কিছুক্ষণ আগে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির আঘাতে তার বন্ধুকে হারিয়েছে)।
‘ঈশ্বর আমাদের ঘৃণা ও আধিপত্য থেকে রক্ষা করুন। রক্ষা করুন যুদ্ধ থেকে, যা মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে। আমাদের মনে সঞ্চার করুন সব মানুষের ভালোবাসা।’ (ম্যাকিনলের প্রার্থনা)।
১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম হামলা, ৯ এপ্রিল আরেক দফা বর্বর হামলা। দিনটি ছিল শুক্রবার, যখন মানুষ জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে আসে তখন তারা হামলা চালায়। ১৪ এপ্রিল ১৯৭১, ম্যাকিনলে তাঁর পরিবার নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। পথে পাকিস্তান বাহিনীর হামলার ধ্বংসযোগ্য তাঁদের চোখ এড়ায় না। এখানে তাঁরা সামরিক সরবরাহ বাক্সের গায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ছাপ দেখতে পায়।
আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেও যুদ্ধের সময় এই ম্যাকিনলে দাঁড়িয়েছিলেন অসহায় বাঙালির পাশে। যেটা তাঁর একটি কথায় ফুটে ওঠে, ‘আমি ও আমার ছেলেমেয়েরা যখন আমাদের বাড়ির হলপথে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলাম, তখন আমরা জানতাম মাথার ওপর নিচু হয়ে নেমে আসছে যে প্লেন সেটা আমাদের দেশের তৈরি।’
তিনি আরেক জায়গায় আমেরিকা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না আমার সরকার মানবতায় বিশ্বাসী।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করায় তিনি এমন কথা বলেছেন।
যুদ্ধ চলাকালে সরকারি পত্রিকাগুলোর মিথ্যা খবরের একটা দৃষ্টান্ত রয়েছে এই গ্রন্থে। একটা পত্রিকা লিখেছিল, ‘সরকার বস্তি এলাকা পরিষ্কার করে সেখানে আধুনিক বাজার নির্মাণ করছে।’
ম্যাকিনলে যুদ্ধ চলাকালে ফেনী, কুমিল্লা, পাবনা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সাধারণ মানুষ ও মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।
৬ ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ এলেও এই দেশের মানুষের প্রতি আত্মার টান থেকে তাঁরা থেকে গেলেন। যাওয়া–না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘থেকে যাওয়াটা অনেক সময় সহজসাধ্য ছিল না; কিন্তু চলে যাওয়াটা হতো আরও কঠিন’।
তাঁদের মাথার ওপর যুদ্ধবিমান, ঘরের আশপাশে বোমার আঘাত, ওত পেতে থাকা মৃত্যু—এত কিছুর পরও ৩০ লাখ বাঙালির মতো বিজয়ের অপেক্ষায় থেকেছেন। লাখো বাঙালির সঙ্গে উদ্যাপন করেছেন বিজয়োৎসব।
ম্যাকিনলে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও সেই সময় তাঁর সহযোগিতা যে কতখানি, সেটা পাঠক এই গ্রন্থ পড়লে বুঝতে পারবেন। মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনী, শান্তি বাহিনী ও রাজাকার সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন। বাঙালি জাতি ম্যাকিনলে এবং তাঁর পরিবারের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে। একজন প্রকৃত বিদেশি বন্ধু।
সারসংক্ষেপ
বই: যুদ্ধদিনের কথা
লেখক: জিম ম্যাকিনলে
রূপান্তর: মফিদুল হক
প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ
মূল্য: ৩২৫
লাইব্রেরি কর্মকর্তা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, পিরোজপুর