শরতে অসময়ের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা ছুঁই ছুঁই। তিন কাঁটা এক জায়গায় মিলিত হতে চলেছে। প্রকৃতিও যেন কাঁদছে প্রীতিলতার জন্য। আকাশে পেঁজা তুলার মতো মেঘের লুকোচুরি খেলা। সুহৃদ আবদুর রহমান খুদে বার্তায় জানিয়েছে, ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে যাবে। আগের দিন ঢাকা থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে চট্টগ্রামে পৌঁছলাম। পটিয়া শহীদ ছবুর রোডে বন্ধুরা মিলে একত্রিত হলাম। ফুল নিয়ে সিএনজিতে রওনা দিলাম। পটিয়া ক্লাব রোডের পর থেকে প্রীতিলতা সড়ক শুরু। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মৃতিবিজড়িত সুচক্রদণ্ডী গ্রাম পেরিয়ে একটু সামনে গেলে চোখে পড়বে পুকুরপাড়ে ১৯২৭ সালে নির্মিত দক্ষিণ ভুর্ষি এলাকায় জগৎচন্দ্র মহাজনের পান্থশালা। এটি ক্লান্ত পথিকদের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল, যাতে একটু বিশ্রাম নিতে পারে।
ধলঘাট যাওয়ার পথে দেখা মিলবে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বৃক্ষ। মাঠে সবুজ ধানের চারা, শস্যখেত, দূর থেকে দেখলে মনে হবে প্রকৃতির বিছিয়ে দেওয়া সবুজ গালিচা। রাস্তার মাঝখানে রেললাইন। ধলঘাট ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। সিএনজি থেমে গেল প্রীতিলতা ট্রাস্ট অফিসের সামনে। ধলঘাট স্কুল, পাশে বিপ্লবী সাবিত্রী দেবীর বাড়ি। বাড়িটি বর্তমানে অনেকটা দখল হয়ে আছে। এই বাড়িতে মাস্টারদা সূর্য সেন এবং প্রীতিলতাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। বাড়ির পাশে চায়ের দোকান, মাটির চুলায় আগুনের লেলিহান শিখা, চায়ের কেটলি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুভ্র ধোঁয়া উড়ছে এবং একটা ছেলে চা বানাতে ব্যস্ত। রুবেল, প্রথম আলোর পটিয়া প্রতিনিধি রাজ্জাক ভাই, অধ্যাপক মানু বড়ুয়া, ভগিরত দাশ, গৌতম, আহমেদ উল্লাহ, পলাশ রক্ষিতসহ সবাই মিলে গরম গরম পেঁয়াজু, সিঙাড়া খেলাম।
প্রীতিলতা ট্রাস্টের সভাপতি পংকজ চক্রবর্ত্তী আমাদের পুরোনো প্রীতিলতা স্কুলটি দেখালেন। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ছোট স্কুল। ২০০৫ সালে স্কুলটির সামনে স্থাপন করা হয় প্রীতিলতার একটি আবক্ষ মূর্তি। নির্মাণশিল্পী ছিলেন চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরী।
ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কে জেনেছি। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে চমৎকার একটি সিনেমা রয়েছে। ‘খেলে হাম জি জান সে’ সিনেমাটি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। প্রীতিলতার সহযোদ্ধা কল্পনার চরিত্রে অভিনয় করেন দীপিকা পাড়ুকোন, তিরিশের দশকে কল্পনা দত্তের বয়স ছিল ১৭। সে–ও প্রীতিলতার সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।
বন্ধুরা মিলে সিনেমাটি দেখে কেঁদেছিলাম। ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্য সেনসহ বিপ্লবীরা সংগ্রাম করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের সহযোদ্ধা প্রীতিলতা বীর প্রসবিনী পটিয়ার সন্তান।
১৯১১ সালের ৫ মে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পটিয়ার ধলঘাট ইউনিয়নের সমুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার, মা প্রতিভাময়ী দেবী। বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রধান কেরানি। পাঁচ পুত্র-কন্যাসন্তান নিয়ে জগবন্ধু থাকতেন চট্টগ্রাম নগরীর আসকার দীঘি এলাকায়। প্রীতিলতা ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্রিক এবং ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর কলকাতা বেথুন কলেজে দর্শনশাস্ত্র নিয়ে বিএ পাস করেন। ১৯২৮ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য হন প্রীতিলতা। সে সময় বিপ্লবী দলের শর্ত ছিল, প্রয়োজন হলে দেশের মুক্তিসংগ্রামে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে হবে। প্রীতিলতা মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়েছিলেন পটিয়া ধলঘাটের বিপ্লবী সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে। ধলঘাট ব্রিটিশ পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেটি পরবর্তী সময়ে ধলঘাট যুদ্ধ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। এ অভিযানে শত্রুর গুলিতে আহত হন প্রীতিলতা। আহত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, ‘ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে জন্ম নয় আমার। আমি বিপ্লবী কন্যা চট্টলকন্যা অগ্নিকন্যা। মহাবীর ব্রিটিশত্রাস মহানায়ক সূর্য সেনের ভগিনী প্রীতিলতা। বীর চট্টলার মহারানী। আমার জীবন্ত দেহ আমি কাউকে স্পর্শ করতে দেব না। ইংরেজের শক্তি নেই, আমাকে কারাগারে বন্দী করার।’
প্রীতিলতা ২৩ বছর বয়সে পটাশিয়াম সায়ানাইড পান করে না ফেরার দেশে চলে যান। মৃত্যুকালে এক চিরকুটে লিখে যান, ‘দেশের মুক্তিসংগ্রামে পুরুষ ও নারীর পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করেছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারব না।’ আরেকটি চিরকুটে লিখেছিলেন, ‘মেয়েরা যে এখনো পিছিয়ে আছে, তার কারণ তাদের পেছনে রাখা হয়েছে। নারীরা এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যতই কঠিন ও বিপদসংকুল হোক না কেন, ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আমার বোনেরা নিজেদের দুর্বল ভাববেন না। এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হলাম। জীবনের আত্মদান বাংলা ও ভারতের বিপ্লবীদের আরও উদ্দীপ্ত ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাতে উৎসাহ জোগাবে।’
পটিয়া ধলঘাটের দক্ষিণ সমুরায় প্রীতিলতার বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করছে শোভারানী দাশের পরিবার। পঙ্কজ চক্রবর্তী, প্রবোদ রায় চন্দন ও পুলক বাবু তাদের সহযোগিতায় দক্ষিণ সমুরাই বিপ্লবী পূর্ণেন্দু অর্ধেন্দু সুখেন্দু প্রীতিলতা স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বসতভিটার পশ্চিম দিকে প্রীতিলতা ও অর্ধেন্দু দস্তিদারের স্মরণে ১৯৭০ সালে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার।
কালের বিবর্তনে প্রীতিলতা স্মৃতিবিজড়িত ধলঘাট এখন বদলে গেছে। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রীতিলতা কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন। ছয়তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে রয়েছে প্রীতিলতা গণসাংস্কৃতিক মঞ্চ, মাস্টারদা সূর্য সেন রিসার্চ সেন্টার, সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার, প্রীতিলতা শিশুকানন বিদ্যানিকেতন, কল্পনা দত্ত যোশী সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র, নারী উন্নয়ন প্রকল্প দিপালী সংঘ, বিপ্লবী মাতা সাবিত্রী দেবী সেমিনার কক্ষ ও প্রীতিলতা ট্রাস্ট কার্যালয়। প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মিত হয়। প্রীতিলতা কমপ্লেক্সে প্রায় ৩০০ জন শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিক চর্চা করছে। শিশুকাননে ১২০ জন সুবিধাবঞ্চিত পড়াশোনা করছে এবং প্রীতিলতা কমপ্লেক্সে ৫২ জন বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
প্রীতিলতার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে পটিয়া ধলঘাটের সমুরা গ্রাম থেকে যখন ফিরছিলাম, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে। সূর্যের লাল আভা প্রীতিলতার সমাধির দূর্বাঘাসে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে মুক্তার কণার মতো জ্বল জ্বল করছিল। প্রীতিলতা আজও মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি আদর্শ হিসেবে বেঁচে আছেন। থাকবেন অনন্তকাল। তাঁর ৯২তম আত্মাহুতি দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা