রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন শাহিন। বাসায় ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়। সকাল ৬টায় আবার খুলনার বাস ধরতে হবে, জরুরি কাজ আছে। তাই রাতে দ্রুত ঘুমাতে হবে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে সোজা গেলেন বিছানায়। কিন্তু ঘুম আসছে না। মাথায় কেবল দ্রুত ঘুমাতে হবে এ চিন্তা কাজ করছে। চোখে ঘুম ভাব আছে, বারবার চেষ্টা করছেন ঘুমানোর, কিন্তু ঘুম আসছে না।
এই গল্প কাল্পনিক হলেও বাস্তবে অনেকের সঙ্গেই এমনটা ঘটে। সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী সবার সঙ্গেই এমন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের মধ্যে যাঁরা পার্ট টাইম চাকরি কিংবা টিউশনি করেন, তাঁদের বেলায় এটা প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। ক্লাস শেষে টিউশনি এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়, আবার সকাল সাতটায় ক্যাম্পাসে যেতে হয়!
এত ব্যস্ততার ভিড়ে রাতে ঘুমটা আর পরিমাণ মতো হয় না, যা স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ফেইনবার্গ স্কুল অব মেডিসিনের সেন্টার ফর সার্কাডিয়ান অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিনের পরিচালক ড. ফিলিস জি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা আমার সঙ্গে প্রায় সময়ই ঘটে। তবে যদি আপনার ঘুম না আসে, এটা নিয়ে চিন্তিত হবেন না। কারণ, চিন্তা করলে ঘুম আরও আসবে না।’
ঘুমবিশেষজ্ঞ ড. রাজ দাসগুপ্তাও একই মত দিয়েছেন। তিনি সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেক স্কুল অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক। ড. রাজ দাসগুপ্তা বলেন, ‘আমার পরামর্শ থাকবে, ঘুমানোর জন্য জোর করবেন না। কারণ, এতে ব্রেইনে প্রভাব ফেলে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা রিল্যাক্স হওয়ার জন্য যত বেশি চেষ্টা করব, ততই আমাদের মনে হবে যে ঘুমের সময় নষ্ট হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে সিএনএন একটি প্রতিবেদন করেছে। সেখানে সময়মতো ঘুমানোর ছয়টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বেশি আগে ঘুমানোর চেষ্টা না করা
যতই তাড়া থাকুক, কখনো রাত ৯টার মধ্যে ঘুমানোর চেষ্টা না করা ভালো। এটা আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাত ৮ থেকে ৯টার মধ্যে রুমের লাইট বন্ধ করে দিয়ে ১০টায় ঘুমানোর পরিকল্পনা করা যায়। এই সময়ে নীল রঙের আলো থেকে দূরে থাকতে হবে। মোবাইল বা কম্পিউটার ওপেন না করাই ভালো। ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে থেকে এই নিয়ম মানতে হবে। কারণ, আলোর কারণে মনে হবে আপনি দিনের বেলা আছেন, ঘুম ভাবটা আসবে না।
মেডিটেশন, শান্ত হওয়া এবং গভীর শ্বাস নেওয়া
‘ঘুম নিয়ে দুশ্চিন্তা একটি বড় সমস্যা, ’ যোগ করেন ড. রাজ দাসগুপ্তা। তিনি বলেন, ‘এই সমস্যা থেকে একটা সময় ইনসমনিয়ার মতো রোগ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নিজেকে শান্ত করতে মেডিটেশন বড় ভূমিকা রাখে। এই অনুশীলন শরীর ও ব্রেইনকে শান্ত রাখে এবং সহজেই ঘুমের দিকে ধাবিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত ঘুমানোর একটা পদ্ধতি আছে ‘৪-৭-৮ শ্বাস-প্রশ্বাস পদ্ধতি’, যা শরীর থেকে ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে। প্রথমে ৪ সেকেন্ড গভীর শ্বাস নিন। সেটিকে ৭ সেকেন্ড পর্যন্ত ধরে রাখুন, এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে দিন। শ্বাস ছাড়ার সময় যেন ৮ সেকেন্ড পর্যন্ত হয়। এই পদ্ধতিটা বারবার করুন। দেখবেন সব ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে যাবে এবং মুহূর্তেই ঘুম চলে আসবে।’
ভোরে দিনের আলোর সংস্পর্শ
ড. ফিলিস জি বলেন, ‘ভোরে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠেন, খেয়াল রাখতে হবে যেন রুমে বাইরের আলো পর্যাপ্ত থাকে, যা আপনার মস্তিষ্ককে জানিয়ে দেবে এটা দিনের আলো এবং কিছুক্ষণ সূর্যের আলোতে থাকুন।’
আমাদের শরীরে ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ নামের একটি প্রক্রিয়া আছে। এটি শরীরের ভেতর ক্রিয়াশীল একটি ছন্দ। সেই ছন্দের বাইরে আমাদের যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ড. রাজ দাসগুপ্তা বলেন, ‘দিনের সূর্যের আলো আপনার সার্কাডিয়ান রিদম সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। পাশাপাশি এই অভ্যাস আপনার শরীরে এনার্জি বৃদ্ধি করবে এবং রাতে ঘুমের মানও বাড়াবে।’
দিনে হালকা ঘুম
‘বিকেল ৩ থেকে ৪টার মধ্যে ৩০ মিনিটের মতো হালকা ঘুমিয়ে নিতে পারেন এবং চেষ্টা করবেন রাতে দ্রুত ঘুমাতে,’ যোগ করেন রাজ দাসগুপ্তা। এতে রাতে ঘুম ভালো হবে এবং রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যেই ঘুমানো সম্ভব।
অ্যালকোহল এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার না খাওয়া
লাঞ্চের পর আমরা সাধারণ ক্যাফেইনমিশ্রিত বিভিন্ন পানীয় (চা, কফি, কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদি) পান করি। দিনের অন্যান্য সময়ও এগুলো পান করি। এসব পান করা কমাতে হবে। পাশাপাশি যাদের ঘুমানোর আগে মদ্যপানের অভ্যাস আছে, তা পরিহার করতে হবে। রাজ দাসগুপ্তার মতে, ‘উভয় জিনিসই চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নেয়। ডিনারের পর যদি ক্ষুধা লাগে, তখন হালকা নাশতা করা যায় এবং তা যেন সুগার ফ্রি হয়। তাহলে ঘুমে আর ব্যাঘাত ঘটবে না।’
মধ্যরাতে ফোনকল
ধরুন, রাতে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন কিংবা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক এমন সময়ে কোনো পরিচিতজন কল দিল। তখন কী করবেন? কারণ, ফোনে কথা বললে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সেটি থেকেও উত্তরণের উপায় বলে দিয়েছেন জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের পালমোনারি এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের মেডিসিনের অধ্যাপক এবং ঘুম গবেষণার পরিচালক ড. ভেসেভোলোদ পোলোটস্কি।
তিনি বলেন, ‘কেউ ফোনকল দিলে সেটা রিসিভ করবেন, তবে রুমের লাইট অন করা যাবে না। শান্ত থাকার চেষ্টা করুন এবং অল্প সময়ে কথা শেষ করে আবার বিছানায় ফিরে যান। যদি আপনি ১০ মিনিটের মধ্যে ঘুমাতে ব্যর্থ হন, তাহলে অন্য রুমে যান এবং ডিম লাইট অন করে কোনো বিরক্তিকর বই পড়ার চেষ্টা করুন। ওই সময়ে ভুলেও কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস (স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ই-বুক অথবা টেলিভিশন) হাতে নেওয়া যাবে না। ই–মেইল কিংবা টেক্সট মেসেজ চেক করা থেকে বিরত থাকুন। এতেও ঘুম না এলে বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করুন। একই সঙ্গে চিন্তা করুন সুখের কোনো মুহূর্ত।’