বেলা বিস্কুট, মধুবন, ধুঁড় পিডা ও বাংলা সাবানের দিনগুলো

শৈশব

ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে মুদির দোকানকে আমরা বলতাম বাজে মালের দোকান। তেল, চিনি, লবণ, মরিচের গুঁড়ার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যকে কেন বাজে মাল বলা হতো, জানি না। বাসন মাজার জন্য কালো একধরনের সাবান কিনে আনতাম; সেই সাবানকেও বলা হতো পচা সাবান। অবশ্য জীবনের ধন বাজে হোক, পচা হোক কিছুই যায় না ফেলা। কলকাতায় একটা ‘ফালতু চা’- এর দোকান আছে। সেই দোকানে চা খেতে ভিড় করে অনেক মানুষ।

ছোটবেলায় পাঁচ পয়সাও দেখেছি। পাঁচ পয়সাতে খুবই ছোট্ট একটা বিস্কুট পাওয়া যেত। এক টাকায় কুড়িটা বিস্কুট, মচমচে বেশ মুখরোচক। চট্টগ্রাম শহর বেশ মজার স্বাদের সব বিস্কুটের জন্য বিখ্যাত। গণি বেকারির ঐতিহাসিক বেলা বিস্কুট শৈশবজুড়ে রয়েছে। পাথরঘাটা বাসার কাছে কাঞ্চন কাকুর দোকান থেকে এই বেলা বিস্কুট কিনে আনতাম। শক্ত বিস্কুট এমনি খেতে ভালো লাগে না। চা-তে চুবিয়ে মুখে তুললে অমৃত স্বাদ বেরিয়ে আসত। মা স্কুলের টিফিনেও মাঝেমধ্যে বেলা বিস্কুট দিতেন। জে এম সেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বন্ধুরা সবাই ভালো ভালো টিফিন নিয়ে আসছে, আমার বেলা বিস্কুটের বাক্স খুলতে কেমন লজ্জা করত। বন্ধুরাও একে অন্যের টিফিনে নজর রাখে। একবার একজন বন্ধু জিজ্ঞেস করাতে বললাম, ‘এটা বন’। দোকানে গোল বন পাউরুটি পাওয়া যায়। বেলা বিস্কুট আকারে একটু ছোট হলেও একেবারে বন পাউরুটির মতো দেখতে। অন্যদিকে টিফিন বাক্সের ভেতরে আমার বেলা বিস্কুটে জল ঢেলে নরম করে রেখেছি, ফলে বন্ধুটি সত্যি সত্যি বিশ্বাসও করে নিল এবং আমার প্রেস্টিজ বজায় থাকল।

আমাকে এবং আমার ভাইকে বাড়িতে পড়াতে আসতেন সুভাষদা। ওনাকে এই বিস্কুট-চানাচুর দেওয়া হতো। বাড়িতে অতিথি এলেও তৎক্ষণাৎ এই বিস্কুট, চানাচুর দিয়ে চা দেওয়া হতো।

বাবার সঙ্গে গিয়ে বাসার জন্য অন্য ভালো বিস্কুটও কিনে আনতাম মধুবন থেকে। চট্টগ্রামে কোতোয়ালি থানার কাছে ছিল সুবিখ্যাত মধুবন বিস্কুটের দোকান। বড় টিনভর্তি বিস্কুট কিনে আনতাম। গ্লুকোজ বা হরলিকস বিস্কুটের মতো দেখতে সেই সুস্বাদু বিস্কুট আমরা ভাই বোনেরা পুরো মাস ডানো দুধের সঙ্গে খেতাম। ডানো পাউডার দুধের টিনগুলোও ছিল বেশ বড়। শেষ হয়ে গেলে সেগুলোতে মুড়ি ভরে রাখা হতো। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু পরিবারের চরম অভাবে বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। একটা এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যবিষয়ক কাগজে আট বছর চাকরি করেছি। তখন জানতে পারলাম, এখানে বাচ্চাদের কৌটার দুধ খাওয়ানো একপ্রকার আইনত নিষিদ্ধ। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ, এরপর ধীরে গরু দুধ চালু করা শিশুর সুস্থ সবল বেড়ে ওঠার জন্য জরুরি। তবে কৌটার দুধ লুকিয়ে চুরিয়ে এখানেও ভালোই বিক্রি হয়। একবার শিশু ডাক্তারদের একটা সম্মেলনে গিয়ে দেখতে পেলাম, সেই সম্মেলন আয়োজন করার জন্য যে ওষুধের কোম্পানি কিছু খরচ করেছে, তাঁরা নিজেদের কৌটার দুধ সাজিয়ে রেখেছেন। আমার পরিচিত বিখ্যাত একজন শিশু ডাক্তার অতিথি হয়ে সম্মেলনে এসে বিষয়টা দেখে এতটাই রেগে গেলেন, আমার মাধ্যমে আয়োজক ডাক্তারবাবুকে হুমকি পর্যন্ত দিলেন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। আয়োজক ডাক্তারবাবু ক্ষমা চেয়েছেন ভবিষ্যতে এ ধরনের বড় ভুল কখনো করবেন না।

মধুবন বিস্কুটের দোকান থেকে ভালো বিস্কুট ও চানাচুর কিনে আনতাম। আমাকে এবং আমার ভাইকে বাড়িতে পড়াতে আসতেন সুভাষদা। ওনাকে এই বিস্কুট-চানাচুর দেওয়া হতো। বাড়িতে অতিথি এলেও তৎক্ষণাৎ এই বিস্কুট, চানাচুর দিয়ে চা দেওয়া হতো। পশ্চিমবঙ্গে ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় একটা ছোট সাহিত্য পত্রিকা বের করতে শুরু করেছিলাম। ছোটবেলায় সেই মধুবন বিস্কুটের দোকানের প্রীতি থেকেই হয়তো সাহিত্য পত্রিকার একটা কবিতার পাতার নাম দিয়েছিলাম ‘মধুবন’। ঠিক করেছিলাম এই পাতায় শুধু প্রেমের কবিতা রাখব। দরিদ্র ছন্নছাড়া উদ্বাস্তু জীবনে প্রেম বলে তো কিছু নেই; নিজে প্রেমের কবিতা লিখে এবং বন্ধুদের প্রেমের কবিতা ছেপে যদি ভালো থাকা যায়, সেই চেষ্টা করে যাওয়া।

শুক্রবার সকালে পরোটা আনতে যেতাম ঢাকা মিষ্টান্ন ভান্ডার নামের একটা মিষ্টির দোকানে। আমাদের পাথরঘাটা বাসার কাছেই ছিল দোকান। পরোটা তো অনেক দোকানেই পাওয়া যায়, কিন্তু সেই দোকানে পরোটার সঙ্গে দেওয়া তরকারিটা খেতে বেশ ভালো লাগত। শুক্রবার ছুটির দিনে সকালের নাশতাটাও জমে উঠত।

বাড়িতে মাঝেমধ্যে ডিম রান্নার জন্য ডিম কিনে আনতাম কাঞ্চন কাকু বা সুমনদের দোকান থেকে। একটা ডিম আড়াই টাকা করে কিনতাম। পরে বেড়ে তিন টাকা, সাড়ে তিন টাকায় পর্যন্ত কখনো কিনেছি। একটা ডিম দুই ফালি করে আলু দিয়ে মা রান্না করতেন। দুপুরে এক ফালি আর রাতে এক ফালি পেতাম। সেই নব্বইয়ের দশকেই উদ্বাস্তু হয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গে চলে এলাম, এখানে দেখলাম একটা ডিম পঁচাত্তর পয়সা করে বিক্রি হচ্ছে। ষোলো-সতেরো টাকায় তিরিশটা ডিমের একটা ট্রে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের জীবনে এতটাই অভাব যে সেই পঁচাত্তর পয়সার একটা ডিম কিনেও মা চার ফালি করে রান্না করেছেন। কখনো আলু কুচি কুচি করে কেটে একটা ডিম ভেঙে দুই বেলার রান্না। আলুর বদলে ঝাড়জঙ্গল থেকে কচু তুলে এনে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত আমাদের রান্না হতো। সেই পঁচাত্তর পয়সার ডিম ক্রমে বেড়ে এক টাকা পঁচিশ পয়সা, এরপর দুই টাকা, গত ৩০ বছরে বাড়তে বাড়তে এখন সাড়ে ৬ টাকা, কখনো ৭ টাকায় কিনি। কাগজে দেখেছি বাংলাদেশে ডিমের দাম ৯ টাকা বা ১০ টাকা। তাহলে হিসাব করে বোঝা যায়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে আমার কেনা ৩ টাকার ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ৩ গুণ। আর পশ্চিমবঙ্গে ডিমের দাম বেড়েছে ৮ থেকে ৯ গুণ। তবে এখন আমি চাইলে দুবেলা দুটো ডিম কিনে খেতে পারি। কিন্তু একটা ডিম ভেঙে ঝোল রান্না করা আমার মা জীবনে না খেতে পেয়েই প্রায় হারিয়ে গিয়েছেন। ওনাকে আমি আর ফিরে পাব না।

শীত এলে মায়ের হাতে পিঠার কথাও খুব মনে পড়ে। ভাপা পিঠাকে চট্টগ্রামের ভাষায় আমরা বলতাম ধুঁড় পিডা। চালের গুঁড়ায় গুড়, নারকেল মিশিয়ে, হাঁড়িতে পানি দিয়ে তার মুখে একটা কাপড় বেঁধে দিতেন। এরপর কেটলির ঢাকনা অথবা কুরিয়ে নেওয়া নারকেলের খোলার ভেতরে সেই মেখে রাখা চালের গুঁড়া ভরে নিয়ে হাঁড়ির ওপরে চাপিয়ে দিতেন। জল টগবগ করে ফুটত, ভাপ উঠত, তাতেই তৈরি হয়ে যেত পিঠা। শীতকালে কাশশীষ গ্রামে থাকা আমার বড় মাসি এবং বারোকাইন গ্রামে থাকা ছোট মাসিও আমাদের শহরের বাসায় খেজুর রস আর পিঠা বানিয়ে পাঠাতেন। বাবা দেশ ছেড়ে চলে আসার পরও শহর ছেড়ে ওদের দুজনের বাড়িতে গিয়েছিলাম বহুদিন। তখনো অনেক পিঠা খাওয়া হয়েছে। খেজুর রস দিয়ে চিতই পিঠার স্বাদ কোনো দিন ভুলে যাওয়ার নয়। সরস্বতীপূজায় ভাপা পিঠার ভেতরে একটা পাতাও গুঁজে দেওয়া হতো। সেই পাতা খেলে নাকি স্মৃতিশক্তি বাড়ে। শহরের বাসায় আমার মা ডিমের অমলেট করার মতো জলরুটি, চুষি পিঠাও বানাতেন। বন্ধুদেরও ডেকে এনে খাওয়াতাম। কলকাতার রাস্তায় ইডলি বড়া দেখে প্রথম প্রথম ভাবতাম ভাপা পিঠা। পরে বুঝলাম তা নয়, অন্য ধরনের একটা খাবার।

পাথরঘাটা জাইল্যাপাড়ার রাস্তা পেরিয়ে গলির মুখে সেন্ট স্কলাস্টিক স্কুলের কাছে একটা মুদির দোকান থেকে গোটা মাসের বাজার আনতাম। সয়াবিন তেল, শর্ষের তেল, নারকেল তেল, মরিচগুঁড়া, হলুদগুঁড়া এসবের সঙ্গে থাকত দুইটা অথবা তিনটা গোল্লা সাবান। আমরা বলতাম বাংলা সাবান। বাড়িতে আনার পর মা গুনা তার দিয়ে কেটে একটাকে চার ফালি করে রাখত। কাপড় জামা ধোয়াকাচার জন্য ঐতিহাসিক এই সাবান কাজে লাগে। আমাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিল কাপড় ধুতে শুধু গোল্লা সাবান লাগে। পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রথম দেখলাম এখানে গোল্লা সাবান নেই, কাপড় ধুতে সবাই জলে গুলে সার্ফ ব্যবহার করে।

বাবা এবং আমাদের ভাইবোনের জামাকাপড় মা ধুয়ে দিতেন। কখনো শুক্রবারে স্কুলের পোশাক নিজে ধুতে নিয়ে যেতাম বিল্ডিংয়ের নিচে ওয়াসার টাইম কলে। পাশের বাসার টিপু দাও আমার সঙ্গে থাকত। মোটর চালিয়ে ওয়াসার পানি তিনতলার ওপরে ছাদে ট্যাংকে উঠে। কখনো আমি নিজে ছাদে গিয়ে ট্যাংকের নব ঘুরিয়ে দিতাম। সবার ঘরে জল চলে যেত।

দু-একবার ইচ্ছা হয়েছে পাকা এই জলের ট্যাংকের ভেতরে নেমে পুকুরের মতো ডুব দিই। কিন্তু তা করা হয়নি। তবে একবার গরমের দুপুরে ছাদে কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে ট্যাংকের ভেতরে শব্দ শুনতে পেলাম। উঁকি দিয়ে দেখি তিনতলার পার্থদা একেবারে উলঙ্গ, ট্যাংকের ভেতরে জলে সাঁতার কাটছে।

এই ছাদে নিম্মি, নিয়াজ, ইমতিয়াজ, মুন্না, কুশন, টিপু, জুঁই, রাসেল, অ্যালভেন, এলিটা আমরা আবাসিক বন্ধুরা সবাই মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। আমার মা টবে কিছু গাছও রেখেছিলেন ছাদে। একবার বন্ধুরা সবাই মিলে চড়ুইভাতিও করেছি। সবার জন্য একটা করে ডিম, চাল, ডাল এসব দিয়েছি। সবজি কিনে এনেছে অন্যরা। অ্যালভেনের বাবা বলেছিল মাংস কিনে এনে দেবে, কিন্তু ঠিক সময়ে দিতে পারেনি। তাই দুপুরে চড়ুইভাতি করে রাতে অ্যালভেনদের বাসায় আবার সবাই খেয়েছে। অ্যালভেন ছিল আমার খুব ভালো বন্ধু। ওর মা বাংলাদেশে থাকা একটা ভারতীয় বেসরকারি সংস্থায় বড় চাকরি করতেন। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। বড়দিনে ওদের বাসায় কেক বানানো থেকে শুরু করে সবাই মিলে কত আনন্দ করেছি। পূজার সময় সবাই মিলে এখানে–ওখানে ঘুরেছি। বাড়িতে মা থাকত না বলে অ্যালভেন আর এলিটাও স্কুল থেকে ফিরে মাত্র আমাদের বাসায় খেলতে চলে আসত। খেলা খেলা বেলা কেটে যাওয়ার দিনগুলো সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে কত দূরে। মনে পড়লে আজও মনে আনন্দ জাগে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত