মা হওয়া নয় মুখের কথা

মায়ের সঙ্গে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমি তখন ক্লাস ইলেভেনে। শাড়ি পরে স্কুল যাওয়া। এখনো ওই দক্ষ যজ্ঞটা মনে আছে। ওটাকে যাওয়া বলে না, ওটা একপ্রকার ম্যারাথন। ঠিক এমন একটা আনকোরা নতুন সময় যেখানে পড়াশোনার বিষয় থেকে শুরু করে মানসিকতা—সব জায়গায় রাখা ছিল জীবনের নতুন চমক। অভিজ্ঞতারা ততক্ষণে আমায় খুঁজে নিয়ে ধাপ্পা বলতে শুরু করেছে।

ঠিক এমনই সময়ে মা–ও নিজের জীবনের একটা নতুন অধ্যায় খুলল। হেঁশেলের মসলার দাগ ছোপানো ছাপাশাড়ি পরা মায়ের কাঁধে উঠল অফিসের ব্যাগ। হ্যাঁ, মা নতুন চাকরি পেল। বাস ধরে ব্যাগ কাঁধে, বাসে ভিড় ঠেলে মাকে ছুটতে হলো অফিস। এ ক্ষেত্রে অফিস আর বাবার কোলাজটা সহজে বানানো গেলেও এই ফ্রেমে মা একপ্রকার লড়াই করেই নিজের জায়গা করেছিল। জীবনের বইয়ে মলাটের পরের প্রস্তাবনা, সম্পাদকীয় এবং মুখবন্ধ ইত্যাদি তত দিনে পেরিয়ে গেছে মা। মেয়ে, মেয়ে থেকে বউ আর বউমা থেকে দুই মেয়ের মা। সংসারে মা তখন অনেকটা জ্বরের প্যারাসিটামল আর শীতের দিনে আদা চায়ের মতো ভীষণ জরুরি!

ভাত-ডাল-চচ্চড়ির একঘেয়ে জীবনে বাড়তি মসলা ছড়াল চাকরিটা। সবটা মিলিয়ে মা হয়ে উঠল সুপারউইমেন। নীলষষ্ঠীর ব্রত থেকে সত্যনারায়ণের সিন্নি সবেতেই মায়ের সহজাত সাবলীল ভাব আমাকে বরাবর ভাবিয়েছে। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে যখন সবাই অফিসের ব্যাগটা ছুড়ে দিয়ে চা জলখাবারের হুকুম করে আর আমার অফিসফেরত মা সেই জায়গায় এক গ্লাস জল চাওয়ার বদলে সন্ধেবেলায় সবার জন্য নুডলস বানায়। এরই ফাঁকে আমাকে রান্নাঘরে ডেকে ফ্রিজ খুলে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলে রাতে কিন্তু তোর ফেবারিট মোচার তরকারি তা–ও আবার চিংড়ি মাছ দিয়ে।

খুব বেশি করে অবাক হই বাড়িতে যেদিন কারোর জন্মদিন থাকে। মা পুরো পাত সাজিয়ে রান্না করে, কপালে পুজোর পয়সা ছুঁয়ে রাখে আর মিষ্টি পায়েস রাঁধে। এসব করে মা আবার জার্নাল লেজারের চাপ সামলে অফিসের ব্যালান্স সিট দিব্য বজায় রাখে। যাকে বলে নো ডেফিসিট। তাই রাস্তায় যখন কেউ আমাকে দেখে বলেন, ‘ঠিক মায়ের মতো দেখতে হয়েছিস’ তখন হাসিমুখে একটু গর্ববোধ করলেও ভেতরে–ভেতরে ভয় পাই। কারণ, মা হওয়া নয় মুখের কথা!

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত