দাবদাহে ত্বকের সুরক্ষা

সানস্ক্রিন এনভায়রনমেন্টাল স্ট্রেস, দূষণ ও অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও ত্বককে রক্ষা করেছবি: পেকজেলসডটকম

দেশব্যাপী চলছে হিট অ্যালার্ট। এই হিট অ্যালার্টের কারণে আমাদের ত্বক কিন্তু হুমকির মুখে। মধ্যপ্রাচ্যের থেকেও এখন বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেশি। অতিরিক্ত তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে আমাদের ত্বকও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যেহেতু আমাদের বহিরাঙ্গ ত্বক এবং ত্বককে বলা হয় শরীরের সবচেয়ে বৃহত্তম অঙ্গ। এ ছাড়া চারপাশের পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয় ত্বককেই। তাই পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যের প্রভাব ত্বকে পড়ে; এটা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। প্রচণ্ড গরমে নিজের ত্বককে সুস্থ রাখতে, সর্বোপরি নিজেকে সুস্থ রাখতে মেনে চলুন এই নিয়মগুলো।

গরমে ঘামের সমস্যা
যাঁদের হাইপারহাইড্রোসিস বা অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা আছে, তাঁরা এ সময়টাতে আরও বেশি পরিমাণে সমস্যার সম্মুখীন হন। অনেক সময় এটি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, ডায়াবেটিস, ভিটামিন ডির অভাব—এসব কারণেও অস্বাভাবিকভাবে ঘাম হতে পারে। যাঁরা অতিরিক্ত ঘামের সমস্যায় ভোগেন, তাঁরা অনেক সময় অতিরিক্ত ঘাম বা দুর্গন্ধ এড়ানোর জন্য অতিরিক্ত ক্ষারযুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করেন। তাঁদের প্রতি অনুরোধ, ক্লিনজার যেন মাইল্ড ও হাইড্রেটিং হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

অতিরিক্ত ঘাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা চিকিৎসকেরা কিছু মেডিকেশন দিয়ে থাকি। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে বা ডায়াবেটিস থাকলে এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলি এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য মেডিটেশন করতে বলি। দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিটেশন করতে বলি। যাঁদের হাত-পা অতিরিক্ত ঘামে, তাঁদের অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড বা অ্যালকোহল বেজড—এ ধরনের কিছু সমাধান বা রোলঅন হাত ও পায়ে ব্যবহার করতে বলি। পানির সঙ্গে যদি একটু গোলাপজল মিশিয়ে নেন, তাহলে ঘামের সঙ্গে দুর্গন্ধটাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ ছাড়া গ্রিন টির নির্যাস পানির সঙ্গে মিশিয়ে রাখলে এটি ন্যাচারাল অ্যাস্ট্রিনজেন্ট হিসেবে কাজ করে আপনার ঘামকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই সঙ্গে দুর্গন্ধকেও। অনেকেই ঘাম বা দুর্গন্ধ এড়ানোর জন্য অতিরিক্ত রোলঅন ব্যবহার করেন। এই রোলঅন থেকেও অনেকের র‍্যাশ বা ডার্মাটাইটিস দেখা দেয়।

গরমে ত্বকের রোগ
এই সময়ে ত্বকের যে রোগগুলো দেখা দেয়, এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ঘামাচি। এটিকে আমরা প্রিকলি হিট বা হিট র‍্যাশ বলে থাকি। প্রিকলি হিটের ট্রিটমেন্টই হচ্ছে ঠান্ডা জায়গায় থাকা। ফ্যানের বাতাসে ঘাম শুকাবেন বা এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা থাকলে, সেখানে থাকবেন। এ ছাড়া প্রিকলি হিট সোপ পাওয়া যায়, সেটি ব্যবহার করবেন আর র‍্যাশের জন্য যদি বেশি ইচিং হয়, সে ক্ষেত্রে ক্যালামাইন লোশন ব্যবহার করতে বলি এবং মুখে অ্যান্টিহিস্টামিন খেতে বলি। অনেক সময় মাইল্ড টপিকাল স্টেরয়েডও ব্যবহার করতে বলি। ত্বকের সফট টিস্যু ইনফেকশন, যেমন ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনও দেখা দেয়। এদের মধ্যে ফাঙ্গাল ইনফেকশন খুবই কমন। একে টিনিয়া বলে থাকি, যা শরীরের যেকোনো অংশে, বিশেষ করে ত্বকের ভাঁজে, নখে বা অন্য জায়গায় হয়ে থাকে। এ সময়ে সাধারণত চুল থেকে শুরু করে শরীরের যেকোনো জায়গায় এই ছত্রাকজনিত ফাঙ্গাল ইনফেকশনগুলো দেখা দেয়। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আরামদায়ক বা ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করবেন।

ভেজা কাপড় দিয়ে দ্রুত ঘাম মুছে ফেলুন। মডেল: জাহিদ
ছবি: সুমন ইউসুফ

ছত্রাকজাতীয় সমস্যাগুলো কিন্তু খুবই ছোঁয়াচে। শরীরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিমেষেই ছড়িয়ে যেতে পারে। ছত্রাকের সমস্যাগুলো হওয়ার পরে আপনি যদি পরিপূর্ণভাবে চিকিৎসা সম্পন্ন না করেন, তাহলে এটি পুনরায় হতে পারে এবং পরিবারের অন্য সদস্যকেও আক্রান্ত করতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের, যাঁরা রান্না করছেন চুলার পাশে, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তাঁদেরও এটি হতে পারে। তাই নিজেদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। চিকিৎসক যত দিন পর্যন্ত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেন, তত দিন পর্যন্ত অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। যাঁরা বয়স্ক, তাঁদেরও এ সমস্যা হতে পারে। সুতরাং নিজেরা সাবধানে থাকবেন, তাঁদেরকে একটু পর্যবেক্ষণ করবেন। গোসলের সময় অ্যান্টিফাঙ্গাল সোপ বা শ্যাম্পু ব্যবহার করবেন।

সানবার্ন
সানবার্নের কথা সবাই জানি। এবার যে গরম পড়েছে, অনেকে বলে বাইরে গেলে আগুনের ফুলকি গায়ে পড়ছে। এটাও বলছে যে এ ধরনের গরম নাকি আগে কখনোই অনুভব করেনি। সাধারণত আমরা যাঁরা বাঙালি, আমাদের বার্নের থেকে ট্যান বেশি হয়। কিন্তু এবার যে গরম, তাতে ট্যানের পাশাপাশি বার্নও হচ্ছে। শুধু সানবার্ন নয়, ফটো ডার্মাটাইটিস বা সূর্যের আলোয় হিট রিঅ্যাকশন হয়ে অ্যালার্জি হচ্ছে। ত্বক–বিশেষজ্ঞরাই আলাদা করে সেগুলোর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এ সমস্যাগুলো এড়িয়ে চলতে সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন অবশ্যই। এতে ত্বক সুরক্ষিত থাকবে এবং ত্বকের ব্যারিয়ার রিপেয়ার হবে। সানস্ক্রিনের কাজ তো শুধু একটি নয়; এটি এনভায়রনমেন্টাল স্ট্রেস, দূষণ ও অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও ত্বককে রক্ষা করবে।

সানস্ক্রিনের উপাদানগুলোয় লক্ষ রাখবেন, যেন জিঙ্ক, যেটি ত্বক পুনর্গঠনে কাজ করে, নিয়াসিনামাইড, যেটি সেবামকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এগুলো থাকে। সোয়েট প্রুফ সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন। কেননা, এ সময়ে যদিও বাইরে গেলে সবাই সানস্ক্রিন ব্যবহার করে, অনেক সময় ত্বক অতিরিক্ত তৈলাক্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে আধুনিক ত্বক–বিশেষজ্ঞরা এই গরম আবহাওয়ার জন্যই কাস্টমাইজ করে সানস্ক্রিন তৈরি করেছেন, যা ত্বককে অতিরিক্ত তৈলাক্ত করবে না। বাইরে গেলে ছাতা, টুপি বা স্কার্ফ ব্যবহার করবেন। এতে আপনার চোখ, মাথার ত্বক সুরক্ষিত থাকবে। নরম, ঢিলেঢালা, ফুলহাতা ও সুতির কাপড় পরবেন। কেননা, কাপড়ের কিছু আল্ট্রাভায়োলেট প্রটেকশন ক্ষমতা থাকে। এই সময়ে হালকা রঙের কাপড় পরবেন। কালো রঙের কাপড় পরিধান করবেন না। কারণ, এর তাপ শোষণ ক্ষমতা বেশি।

স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট, যেমন ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো কুলিং ইফেক্টযুক্ত এবং বোটানিক্যাল এক্সট্রাক্ট থেকে তৈরি হয়। সাধারণত বোটানিক্যাল এক্সট্রাক্ট, যেমন ক্যামোমাইল, কিউকামবার, মিন্ট এসব এক্সট্রাক্ট থেকে তৈরি প্রোডাক্টগুলোয় সুদিং ও কুলিং ইফেক্ট থাকে।

পানিশূন্যতা এড়ানোর জন্য পানি পান করতে হবে

কোল্ড ক্রিম আমাদের খুব পরিচিত একটি শব্দ। তবে এই গরমে ত্বক রিপেয়ারের জন্য, সুদিং থাকার জন্য সাধারণত হায়ালুরোনিক অ্যাসিডযুক্ত সেরাম, ক্রিম বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন; যেটি খুব লাইট ওয়েট হয়ে থাকে। আপনার ত্বকের ময়েশ্চারাইজার বা ক্রিম অনেক সময় ফ্রিজে রেখে একটু ঠান্ডা করেও ব্যবহার করতে পারেন। তাহলেও সুদিং ইফেক্ট আসে। রোদ থেকে এসে আপনি এভাবেই অ্যাপ্লাই করবেন। ভুল করেও ময়েশ্চারাইজার স্কিপ করবেন না। ওয়াটার বেজড, হাইড্রেটিং, সেবাম রেগুলেটর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন। কারণ, এর অভাবে ত্বক ডিহাইড্রেটেড হবে, ময়েশ্চার লস হবে আর ত্বক হারাবে আর্দ্রতা। শুধু সেটা নয়, আপনি যে তৈলাক্ত ত্বকের ভয়ে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে চাচ্ছেন না, তাতে নেগেটিভ ফিডব্যাক মেকানিজমে অয়েল গ্ল্যান্ড আরও বেশি করে অয়েল উৎপাদন করবে।

পানিশূন্যতা
পানিশূন্যতা এড়ানোর জন্য পানি পান করবেন। এ সময় ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালান্স হয়। ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, পানীয় বলতে কিন্তু রঙিন পানীয়, কোমল পানীয় বা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত শরবত বা প্যাকড জুস না; ঘরের তৈরি ফলের রস খাবেন, সিজনাল যে ফলগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো খাবেন। এ ছাড়া ইনফিউশন বা ডিটক্স ওয়াটার পান করতে পারেন। হয়তো ভয় পেয়ে যাচ্ছেন ডিটক্স ওয়াটার বা ইনফিউশনটি কীভাবে তৈরি করতে হয়। আপনার কিচেনে যে মৌসুমি ফল ও সবজি আছে, যেমন শসা, গাজর, পুদিনাপাতা—এগুলো পানিতে ভিজিয়ে বা পানিসমৃদ্ধ ফল, যেমন তরমুজ, আনারস কেটেও জারে পানির সঙ্গে রেখে এই ফ্লেভার্ড ড্রিংক তৈরি করতে পারেন। একটু একটু করে পান করবেন। আপনার পানিশূন্যতা ও পানির ঘাটতি পূরণ হবে এবং থাকবেন সুস্থ। মনও ভালো থাকবে। কারণ, ডিহাইড্রেশনের জন্য শুধু ত্বক ডিহাইড্রেটেড হয় না; শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও এর প্রভাব পড়ে এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। এই সময় আমার কাছে যাঁরা আসছেন বা অনলাইনে যাঁরা দেখছেন, সবাই একটাই অভিযোগ করছেন যে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভুগছেন। এই মাথাব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ কিন্তু ডিহাইড্রেশন।

ওয়েলনেস অ্যান্ড বিউটি কনটেস্ট কনসালট্যান্ট এবং স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ