ওম

প্রতীকীছবি: আনিস মাহমুদ
আজমত ফকিরের এখন দুজনের সংসার। ভিক্ষা করে যা পায়, সেখান থেকে খাবারের কিছু অংশ কুকুরটার জন্যও বরাদ্দ থাকে।

সারা দিন ভিক্ষা করে মিলেছে পাঁচটি ২ টাকার কয়েন, দুটি ১০ টাকার জীর্ণ নোট আর তিনটি ৫ টাকার নোট। খেতে হবে তিন বেলা। প্রতিদিন মানুষের কাছে হাত পাততে ভালো লাগে না আজমত ফকিরের। হাত পাতে এক দিন পরপর। একা মানুষ, সারা দিনে যা পায়, তা দিয়ে দুই দিন কোনোমতে চালিয়ে দিতে পারে। অনেক সময় আবার অনেকে খাবারও দিয়ে যায়, তবে সেটা ভাগ্যের ওপর। ভাগ্য ভালো থাকলে মাসের দুয়েক দিন এমন ঘটনা ঘটে। সেদিন আয়েশ করে খেতে পারে। আজও পেয়েছে, বিরিয়ানির প্যাকেট। এখনো খুলে দেখেনি, প্যাকেটের ভেতরে থাকা খাবারের গন্ধই জানান দিচ্ছে।

খাবারের জন্য একটু সকাল সকালই নিজের ডেরায় ফিরেছে সে। প্যাকেটটা পাশে রেখে টাকার হিসাবটা মিলিয়ে নিল। আজকের মোট হিসাব পাঁচ টাকা কম দুই কুড়ি। অন্য দিনের চেয়ে একটু কমই। কিন্তু তাতে আফসোস নেই। ভালো খাবার পেলে টাকা না পেলেও কোনো আফসোস নেই। সব তো পেটের জন্যই। তবে তার আরেকটা ব্যাপার আছে, সেটা হচ্ছে নিজের শরীরের আরাম। একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। গতবারের কম্বলটা জানি কে নিয়ে গেছে। কম্বল কেনার সম্বল তার নেই। তাই কবে কে একটা কম্বল দিয়ে যাবে, সে আশাতেই বুক বাঁধছে।

পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। পাশেই বিরিয়ানির প্যাকেট। কিন্তু খেতে পারছে না। আসার সময় একটা নাদুসনুদুস কুকুর পেছন পেছন তার ডেরা পর্যন্ত চলে এসেছে। মনে মনে সে খাবারের ভাগ কাউকে দিতে চাচ্ছে না, তাই প্যাকেটটা খুলছে না সহজে। এদিকে কুকুরটাও যাচ্ছে না। আটঘাট বেঁধেই বসেছে যে যাবে না। বিরিয়ানি সে খেয়েই যাবে। কয়েকবার তাড়াতেও চেয়েছে, কিন্তু সে বেচারা আর যাওয়ার নয়। হঠাৎ মনটা নরম হলো আজমতের। তার যেমন কেউ নেই, এই বোবা প্রাণীটারও মনে হয় কেউ নেই, যা পেয়েছে ভাগাভাগি করেই খাবে।

কাটা পায়ের ওপর ভর করে একটু বিরিয়ানি কুকুরটার জন্য দিল একটা পলিথিনে। ‘এই নে খা, খেয়ে বিদায় হ’। আজমত ফকিরও খাওয়া শুরু করল। দুজনে বেশ আরামে খাচ্ছে। আজকে আবার একটু বাতাস বইতে শুরু করেছে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। টাকাগুলো জায়গামতো রেখে ছেঁড়া চাদরটা গায়ে দিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়েছে সে। কুকুরটা তখন পাশেই বসে আছে। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে তার গা। ‘খাওন তো শেষ, যা যা তোর জায়গায় তুই যা’। কুকুরটা মাথা নাড়ে। নড়ে না আর জায়গা থেকে।

কখন ঘুমিয়ে গেছে জানে না আজমত। জ্বর আসছে গায়ে। বাতাসে যেন শীত ধেয়ে আসছে তার ওপরে। হাড়কাঁপানো শীতে কলিজা পর্যন্ত কাঁপছে। ছেঁড়া কাঁথাটাকে জড়িয়ে নিয়েছে পুরোপুরি। তাতেও লাভ হচ্ছে না। ঘুমের ভালো পা’টা দিয়ে কিছু একটা জড়িয়ে ধরেছে সে। টের পেল একটু ওম পাচ্ছে। ভোররাত অবধি এভাবেই কাটল। ফজরের আজানের সময় যখন ঘুম ভাঙল, দেখল সে কুকুরটাকেই জড়িয়ে আছে। কুকুরটাও পরম মমতায় তার বুকের সঙ্গে মিশে আছে।

শীত নামার কয়েক দিনের মাথায় একজনে একটা কম্বল দিয়ে গেল তাকে। পুরোনো কম্বল, কিন্তু ভারী। এবারের শীত আরামেই কেটে যাবে। কুকুরটা তখনো পিছু ছাড়েনি।

আজমত ফকিরের এখন দুজনের সংসার। ভিক্ষা করে যা পায়, সেখান থেকে খাবারের কিছু অংশ কুকুরটার জন্যও বরাদ্দ থাকে। সারা দিন তার আশপাশেই ঘুরঘুর করে। কেউ না থাকলে কুকুরটার সঙ্গে কথা বলে, ‘তর বাড়ি কই? কোত্থেকে আসছস?’ কুকুরটা শুধু মাথা দোলায়। আজমত ফকির হাসে।

হঠাৎ শীত নেমেছে। বাপের জন্মে এমন শীত আজমত টের পায়নি। কম্বলটা দিয়ে কোনোমতে হয়ে যায় তার। কুকুরটা একটু দূরেই শুয়ে থাকে। একদিন রাতে ঘুম ভাঙার পর দেখে কুকুরটা শীতে কাঁপছে। তার বিছানাটা একটু টেনে কুকুরটার কাছাকাছি নিয়ে আসে। তারপর কম্বলটা দিয়ে ঢেকে দেয়। এভাবেই চলছিল শীতের বাকি দিনগুলো। কিছুদিন পর শহরে একটা ছবি ভাইরাল হয়। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা শিরোনাম করে, ‘উম’।

মিরপুর ১০, ঢাকা