গালাগালির দুনিয়াতেও বিশ্বায়ন ঘটে গেছে। ছোটবেলায় চট্টগ্রামে পাথরঘাটা জেলে পাড়ায় আমাদের বাসার সামনে জেলেদের মুখে যে ধরনের অসভ্য গালাগাল শুনতাম, খাঁটি ‘চিটাইংঙ্গা’ গালাগাল। ৩০ বছর আগে হঠাৎ জীবন এলোমেলো; উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার পর কিছু চিরাচরিত নির্ভেজাল গালাগালি আগের মতো এখানে শুনতে পেলেও চাটগাঁইয়া ভাষার অদম্য টানের অনেক গালাগালি আর কখনো শুনতে পাইনি। সেই জায়গায় নতুন কিছু অশ্লীল গালাগালি কানে এল। ভাবতাম এগুলো পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব গালাগালি।
তখন এপার–ওপার প্রতিটি মুহূর্তের জন্য পারস্পরিক যোগাযোগব্যবস্থা আজকের মতো এতটা সহজ ছিল না। ফেসবুক চালু হওয়ার অনেক পরে, আমারও একটা প্রোফাইল হলো। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের কিছু বন্ধু হলো। ঢাকার একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা বন্ধু, মাঝেমধ্যে রেগে গেলেই দেখি চরম উত্তেজিত হয়ে চার অক্ষরের একটা বোকা বোকা গালাগালি লিখে স্ট্যাটাস দেয়। এই গালাগালিটা পশ্চিমবঙ্গের রাস্তাঘাটের সহজ জলভাতের মতো গালাগালি। আমিতো এখন আর ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটে কে কী ধরনের গালাগালি দিচ্ছে, শুনতে পাই না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দু-এক পশলা যা বর্ষিত হয়, তা দেখে বুঝতে পারলাম, এই গালাগালির গতিবেগ আলোর গতির থেকেও দ্রুত বেগে ছোটে। এর সংক্রমণ ভালো গান কবিতার সংক্রমণের থেকেও মারাত্মক।
ব্রাত্য বসুর চলচ্চিত্রে মাস্তানিতে মদের ফোয়ারার মতো এই গালাগালিরও ফোয়ারা ছুটেছে। মোশাররফের এসব আয়ত্ত করতে সমস্যা হয়নি।
মোশাররফ করিম বাংলাদেশের রাফ এবং টাফ অভিনেতা। ব্রাত্য বসুও পশ্চিমবঙ্গের রাফ এবং টাফ পরিচালক। দুজনই উর্বরা মাটির ধানী লঙ্কা। পান্তাভাতে শুঁটকি পোড়ার মতো সহজ, আবার পচা ভাত থেকে হাঁড়িয়া মদ বানানোর মতো কঠিন। এই দুজনের মিলনে যখন কিছু ঘটতে যায়, বোঝা যাচ্ছিল তিলে এবং তালে আপামর বাঙালির আপাত ঘুনে ধরা ম্যাড়ম্যাড়ে জীবনের চৌদ্দপুরুষের উদ্ধার হয়ে যাবে। বাস্তবেও হয়ে উঠল সেটাই।
প্রথম দিকে একটু সংশয় ছিল, মোশাররফের অভিনয়ে ভাষার যে ধরনের টান এতদিন দেখে–শুনে এসেছি, একজন ঢাকাইয়া মাস্তানের চরিত্রে খুব সহজে রংবাজি ছড়িয়ে দিতে পারেন; পশ্চিমবঙ্গের হুগলীর একজন মাস্তানের চরিত্রে কীভাবে তিনি এঁটে উঠবেন! রংবাজমাস্তানদের চরিত্র সব জায়গাতে একই, কিন্তু মুখ দিয়ে গোলাগুলি না ছুটলে তিনি আর কী ধরনের মাস্তান। পরে বুঝলাম, ওই যে শুরুতে বলেছি আজকের সহজ যোগাযোগব্যবস্থায় গালাগালিরও বিশ্বায়ন ঘটে গেছে। এক দেশের মুখের গালি অন্য দেশের মুখের সহজ বুলি হয়েও গোলাগুলির মতো ছুটতে পারে। চুল চুলই থাকে; তুমি তোমার ভাষায় মাথার চুলকে যা বলো, আমি আমার ভাষায় তলার চুলকে সেটা গালি বলে জানি, এই যা তফাৎ! ব্রাত্য বসুর চলচ্চিত্রে মাস্তানিতে মদের ফোয়ারার মতো এই গালাগালিরও ফোয়ারা ছুটেছে। মোশাররফের এসব আয়ত্ত করতে সমস্যা হয়নি।
যদিও অধ্যাপক, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব, পরিচালক ব্রাত্য শুরুতেই নিজের কণ্ঠে বিধিবদ্ধ সতর্ক করে দিয়েছেন। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, ক্যানসারের কারণ। মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শুরুতেই লিখে জানিয়ে দিয়েছেন, এই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো কাল্পনিক। যদি কারও কোনো ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পান, সেটা কাকতালীয়।
এখন খুব বেশি সময় না পেলেও, একসময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া অভ্যাস ছিল। একজন কুখ্যাত সমাজবিরোধী মাস্তানকে কলকাতা পুলিশ সিনেমা হল থেকে গ্রেপ্তার করেছে, কাগজে পড়েছিলাম। হুগলীর বৈদ্যবাটির খালে একজন সমাজবিরোধীর লাশ ভেসে উঠেছে, কাগজে দেখেছি। সুতরাং খবরের কাগজে পাওয়া সত্যের সঙ্গে বাস্তবের সিনেমার তথ্যের মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। পাড়া–বস্তির জীবনে রোজ কাকের ডাক শুনতে শুনতে কাকের খুঁটে খাওয়া স্বভাব সিনেমায় দেখে কাকতালীয় মনে হওয়ার কারণ নেই। সিনেমা মানে সব চরিত্র কাল্পনিক নয়, আবার গল্প–উপন্যাস–সিনেমা মানে কিছুটা অনুমাননির্ভর কল্পনা তো থাকবেই। একজন অশিক্ষিত সমাজবিরোধী তো নিজের আত্মজীবনী লিখে যেতে পারেন না। চলচ্চিত্রের শুরুতে যাঁর তথ্য এবং গবেষণার কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন ব্রাত্য, তাঁকে আমি চিনি। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান পুলিশ দপ্তর লালবাজারের একজন দুঁদে পুলিশ কর্তা, একইসঙ্গে একজন ভালো লেখক সুপ্রতিম সরকার। সুপ্রতিমের দাদা সব্যসাচী সরকার বিশিষ্ট কবি এবং ক্রীড়া সাংবাদিক।
আমি থাকি হাওড়া রেলের মেন লাইনে, বেলুড়ে। এই বেলুড় অঞ্চলে ব্রাত্য বসুর শ্বশুরবাড়ি। আমার তিনটি স্টেশন পরেই এই কোন্নগর। একসময়ের হুগলীর ত্রাস, যে হুব্বা শ্যামলকে নিয়ে এই চলচ্চিত্র, তাঁর বসতবাড়ি সেখানে। আরও দুটো স্টেশন পরে শ্রীরামপুর। এই শ্রীরামপুরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাগজে আমি আট বছর সাংবাদিকতা করেছি। সুতরাং চলচ্চিত্রে দেখানো অনেক জায়গা আমার চেনা। ঘটনা অল্পস্বল্প শোনা। হুব্বা কোন্নগরের যে সিনেমা হলটি ভাড়া করে অনেক দিনের ইচ্ছা, একা বসে সিনেমা দেখবে, সাধ পূরণ করছিল; সেই হলে আমিও বেশ কয়েকবার সিনেমা দেখতে গিয়েছি। এখন সেটা আর নেই।
‘হুব্বা’ দেখে উৎসাহিত হয়ে আশা করি কেউ হুব্বা হওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ, হুব্বারা যেমন সাংঘাতিক, পরিণতিও খুব মর্মান্তিক।
ব্যক্তিগতভাবে ব্রাত্য বসুর প্রতিও বিশেষ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আছে। দমদম মতিঝিল কলেজে বিএ পড়তে গিয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম কবি জয়দেব বসুকে। জয়দেব আর ব্রাত্য খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। জয়দেব বামপন্থী সিপিআই এমের ওপরতলার কমরেড আর আমরা অনেকেই ব্রাত্যর মতো মানুষকে সামনে রেখে দীর্ঘদিনের অচলায়তন, বামফ্রন্টের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে যার জায়গা থেকে সরব হয়েছিলাম। ২০০৩ সালে ব্রাত্যর প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাস্তা’ যখন মুক্তি পেয়েছে, আমার উৎসাহের অন্ত ছিল না। শহরের বড় হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মতো পয়সা নেই। বনগাঁ লাইনের একটা হলে গিয়ে ‘রাস্তা’ দেখেছি। সিনেমা দেখে কেমন লেগেছে, পরিচালকের কাছে একটা চিঠি লিখে কলকাতার বড় সংবাদপত্রের পরিচিত এক সাংবাদিকের কাছে দিয়ে এসেছি। তিনি যেন ব্রাত্য বসুর কাছে চিঠিটা পৌঁছে দেন। আনন্দবাজার পত্রিকাতে ব্রাত্য নিজেই নিজের চলচ্চিত্রের সমালোচনা লিখেছেন। নিজেকে নম্বর দিয়েছেন।
সেই চলচ্চিত্রেও অপরাধ জগৎ, রাজনীতি, ঝাড়পিট এসব ছিল। দিনে দিনে একজন পরিচালক যেমন অনেক পরিণত হন, ৫ নম্বর চলচ্চিত্রে এসে আজকের ব্রাত্যর জগৎও আরও অনেক বেশি অন্ধকার দুনিয়ার। একেবারে অতলে গিয়ে সাধারণ মানুষের চোখে যারা দুষ্ট লোক, তাদের দুষ্ট হয়ে ওঠার কাহিনি, রাজনীতির লোকেদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার, প্রয়োজন ফুরোলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, ঘরের ভেতরে পারিবারিক রাজনীতি, নিজেদের মাস্তান দলের মধ্যে রাজনীতি, বাইরের সমাজের রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর রাজনীতি সব তুলে এনেছেন। এ যেন পুরোনো ব্রাত্য, সময়ের দাবীতে নিত্য নতুন ব্রাত্য, পুরোনোকে ছেয়ে ওঠার নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা। নাট্য জগতের মানুষ হওয়াতে ব্রাত্যর একটা সুবিধা, পেশাদারী অভিনয় জগতের নামীদামি তারকার পাশে থিয়েটার জগতের কর্মী চেনা অচেনা অনেককে মনের মতো চরিত্র অনুযায়ী তৈরি করে নিতে পারেন। ব্যবহার করতে পারেন। ‘রাস্তা’ চলচ্চিত্রেও দেখেছিলাম মিঠুন চক্রবর্তী, রিমঝিম, দোলন, রজতাভদের পাশে দেবশংকর হালদারের মতো থিয়েটার অন্তঃপ্রাণ মানুষকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আজকের এই ‘হুব্বা’তেও মোশাররফ করিম, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের পাশে বাচিক শিল্পী, নাট্যব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্র, পৌলোমী বসুদের নিয়ে এসেছেন। তরুণ হুব্বা শ্যামলের চরিত্রে গম্ভীরা ভট্টাচার্য, হুব্বার প্রথম স্ত্রী তাপসীর চরিত্রে জিনিয়া রায়, মারকাটারি অভিনয়ে ওরা ফাটিয়ে দিয়েছেন। হুব্বার মাস্তান দলের এবং পার্শ্ব চরিত্রের প্রায় সবাই নতুন মুখ। মঞ্চ কাঁপানো নাটকের চৌকস সংলাপ লেখা ব্রাত্য চলচ্চিত্রের সংলাপেও উত্তাপ ছড়িয়ে টানটান উত্তেজনায় সবাইকে মোহিত করে রাখতে পারেন।
ব্রাত্য বসুর নিজের ভেতরেও একটা বড় মাস্তান আছে। একেবারে রাস্তা, অন্ধ গলি, তস্য গলি থেকে উঠে আসা সুশিক্ষিত মেধাবী মাস্তান। সৃষ্টির জগতে মাইলের পর মাইলস্টোন ডিঙিয়ে গিয়ে আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মাস্তান। সাংগঠনিক, বৌদ্ধিক দিক থেকেও মানুষকে সংগঠিত করে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের গদি উল্টে দিতে পারেন। আবার বর্তমান তৃণমূল সরকারে একের পর এক নেতা, মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে থাকলেও ‘দুর্নীতিবাজ’ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর আসনে নিজে বসে দায়িত্ব সামলে যেতে পারেন। যাকে বলে এক ধরনের ‘কাঁটার মুকুট’ পরে বসে থাকা। আমরা সাধারণ মানুষেরা সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। ভেতরে এই মাস্তান জেগে না থাকলে চারপাশের এত সমস্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে ব্রাত্য সৃষ্টি সাধনা করতে পারতেন না।
‘হুব্বা’ শ্যামল থেকে ব্রাত্যর হাতে এসে বিমল হয়। আশা করি চারপাশের দেখা এবং শোনা অন্যের চরিত্র বুনতে বুনতে ব্রাত্য নিজেও একদিন নিজের আত্মজীবনীর অংশ রচনা করে ফেলবেন। চলচ্চিত্রে নিয়ে আসবেন। মোশাররফ করিমের লা-জবাব অভিনয় দেখে বোঝা যাচ্ছে, নিরলস পরিশ্রমী শিল্পী সত্তায় জীবনের গাড়িটাকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। দুই বাংলার সংস্কৃতির আদান প্রদানে ব্রাত্য-মোশাররফের মতো মানুষদের একসঙ্গে অনেক কাজ করে যাওয়াটাও জরুরি।
‘হুব্বা’ দেখে উৎসাহিত হয়ে আশা করি কেউ হুব্বা হওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ, হুব্বারা যেমন সাংঘাতিক, পরিণতিও খুব মর্মান্তিক।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত