আমার নানা রঙের বৈশাখের দিনগুলো

বৈশাখের মেলায় নাগরদোলায় সবাই উঠেছবি: সংগৃহীত

সারি সারি আম, জাম ও জামরুলগাছ ঘেরা মাটির দেয়ালের বাড়িতে কেটেছে শৈশব। বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা ছিল বন্ধু। সাঁতার শিখে যাওয়ার দরুন বৈরিতা নয় বরং নদী ও আমি হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিলাম। বড়শিতে আধার গেঁথে ট্যাংরা, পুঁটি মাছ মারা থেকে শুরু করে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নদীর বুকে ঝাঁপ দেওয়ার গন্ধ লেগে আছে শরীরে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়লে লোমকূপ আনন্দে নেচে ওঠে। নানা আয়োজনে, অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত শৈশবের স্মৃতিমাল্য; আয়োজন, অনুষ্ঠান এলেই বিশেষভাবে মথিত করে।

ওই সময়ের পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের কথা চিন্তা করলে, প্রথমেই মনে পড়ে রঙিন জামা। সেই জামার ওপর রং-বেরঙের ছবি আঁকা। এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হতো জামার জন্য আবদার। মধ্যবিত্ত পরিবারে সম্মানের পাশাপাশি ভালোবাসার আধিপত্যও বিরাজমান। অভাব-অনটনের মধ্যে হবে না হবে না করেও এক-দুইটা জামা হতো পয়লা বৈশাখে। বাবা বাজার থেকে আগের দিন রাতে মিষ্টি নিয়ে আসতেন। বৈশাখের প্রথম সকালে মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশীদের বাড়িতে মিষ্টি দিতে যেতাম। একইভাবে তাঁরাও আসতেন দিতে। এরপর ছিল গ্রামের সবচেয়ে বড় দোকানটায় হালখাতা। দোকানদার ভদ্রলোক পরিচিত হওয়ায়, হালখাতা উপলক্ষে দোকান সাজানোর পুরো দায়িত্ব পড়ত এলাকার ছোটদের হাতে। কি আনন্দ, কি হইচইয়ের মধ্যে যে শেষ হতো বৈশাখের প্রথম দিন, বলে বোঝানো অসম্ভব।

তারপরও সময়ের শিলালিপি ক্ষয়ে ক্ষয়ে সব বদলায়। নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় জীবন। তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার পড়ালেখার সুবিধার জন্য পরিবার শহরে পাড়ি জমায়। শুরু হয় শহুরে জীবন। গ্রামের ভালোলাগা, আলোছায়া, আবহাওয়া মিস করলেও থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। পয়লা বৈশাখ আসে, গ্রামের সেই ছুটে বেড়ানো বৈশাখ হারালেও আনন্দ হারায় না, উদ্‌যাপন হারায় না। নতুন জামা, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম জানানো, হালখাতা, প্রতিবেশীদের বাড়িতে মিষ্টি বিতরণের সঙ্গে যুক্ত হয় বর্ষবরণের আয়োজন। কি ব্যস্ততায় কাটত বৈশাখের আগের দিনগুলো। স্কুল শেষ করে বন্ধুদের কেউ কেউ যেত সংগীত একাডেমিতে। কয়েক দিন ধরে একাডেমিতে গানের রিহার্সাল হতো। স্কুলেও ছিল নানা আয়োজন ও প্রতিযোগিতা। বৈশাখের সকালে বন্ধুরা এক রঙের পাঞ্জাবি পরে সম্মিলিত স্বরে গেয়ে উঠতাম, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপসনিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’

সকালের বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হতো বিকালের অপেক্ষা। বৈশাখী মেলায় বন্ধুরা মিলে ঘুরব। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ কাজ করত নাগরদোলায় ওঠার জন্য। মেলা উপলক্ষে নাগরদোলা বসত শহরের মাঠে। বিকেল থেকে শুরু হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গোটা মাঠ লোকে লোকারণ্য। বন্ধুরা মিলে প্রতিটি স্টল ঘুরে দেখতাম। একবার তো বন্ধুদের কয়েকজন মিলেই একটা স্টল দিয়েছিল মেলায়। তখন উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বাড়ি থেকে কাকুতিমিনতি করে অনুমতি নিলাম, বন্ধুদের সঙ্গে রাত দশটা পর্যন্ত মেলায় থাকব। কি আনন্দ সেবার! দিনগুলোর কথা ভাবতেই মন ভালো হয়ে যায়।

পয়লা বৈশাখ, মান-অভিমান, দুঃখের অতীত ভুলে নতুন করে শুরু করার দিন। দিনটি নিয়ে সব সময় এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। ক্রম পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আবারও জীবনযাপনের ধারা বদলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পয়লা বৈশাখ আরও বর্ণিল, আরও আয়োজনমুখর। নববর্ষের নব আহ্বানে প্রত্যেকের জীবন আনন্দে ভরে উঠুক। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক বৈশাখের সুর। ধরিত্রী হোক আনন্দময়।

সাধারণ সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা