আশ্বিনের শেষ সকালে মানুষ ও প্রকৃতি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আশ্বিনের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালছবি: লেখক

ভোর সাড়ে পাঁচটা। আশ্বিনের শেষের সকাল। চারপাশে কুয়াশার তীব্রতা চোখে পড়ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাস, শান্ত পাহাড়ের কোলজুড়ে সবুজ ফসলের মাঠ। পুরোটা ছেয়ে আছে কুয়াশায়। গ্রীষ্ম-বর্ষা পেরিয়ে শরতের শেষ প্রান্তে আমরা। হেমন্ত আসার আগেই কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা।

এমনই এক দিনে স্রষ্টার বিশেষ কল্যাণে হাঁটতে বের হয়েছি। পরনে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক লুঙ্গি। চপ্পল পায়ে হেঁটে চলেছি। সকালের স্নিগ্ধতা, শীতলতা গা ছুঁয়েছে। মনটাও বেশ ফুরফুরে। কুয়াশার টানে শিশিরমোড়ানো দূর্বা পেরিয়ে দূর দিগন্তে চেয়ে আছি। দূরের গাছপালা–বসতবাড়ি চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। রোদ-বৃষ্টির খেলা চলছিল বহুদিন। এ সকাল জানান দিচ্ছে সামনে শীত, কুয়াশা আর মিঠা রোদের দিন।

কুয়াশার নজর ছাপিয়ে মন পাখিদের কাছে। চারপাশে আজ তাদের মেলা। সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছে এ বেলা। নানা জাতের শিল্পী পাখিদের ডাকাডাকি চলছে। কখনো ফিঙে তো কখনো শালিক আবার কর্কশ স্বরের কাক কিংবা খানিক দূরের পাহাড়ে বসে ঘুঘুর ডাকাডাকি। কেউ থেমে নেই। কখনো ডানা মেলে আবার কখনো দল বেঁধে বা জোড়ায় জোড়ায় উড়ে চলেছে। ভোর থেকে ডেকে চলা ডাহুক এখনো সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে সাদা বক উড়ে এসে বসেছে নারকেলগাছটায়। লাজুক মিষ্টি দোয়েল কখনো মাটিতে নেমে আসছে আবার কখনো উড়ে ঢালে বসছে। বৈদ্যুতিক তারে বসা মাছরাঙাও ডেকে চলে গেল দূরে কোনার দিকটায়। উত্তরের বাড়ির মোরগটাও থেমে থেমে হাঁকডাক শুরু করেছে।

হল জাগেনি, পাড়া মাতেনি; কিন্তু পাখিরা জেগে উঠেছে। মানুষ জাগার আগে পাখিরা জেগে ওঠে। মানুষের কোলাহল, যান্ত্রিক জীবন পাখিদের ভালো লাগে না। তাই মানুষ যখন ঘুমন্ত, তখন পুরো পাড়া তাদের দখলে। স্রষ্টার দেওয়া অপূর্ব সুন্দর সকালে তাদের গান, ডাকাডাকি আর কিচিরমিচিরে সকালের নীরবতা ভাঙে।

আজ সকালে পাখিদের সঙ্গী হতে আমিও উড়ে বেড়িয়েছিলাম। তবে ডানা নয়, দুই চাকার সাইকেলে। পাখিদের ডাক, কুয়াশামাখা সকাল আমাকে পাহাড়িয়া ক্যাম্পাসে এক চক্কর দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। দুই পায়ে প্যাডল চলছে সমান তালে। সকালের নীরবতা, পাখির ডাক, শীতল হাওয়া—এসব সঙ্গে করে নিয়ে চলেছি ফরেস্ট্রির দিকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি দিনের চঞ্চল আলোতেই নীরব আর সকালের নীরবতা যেন ঘন অরণ্য।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যকের ঘন অরণ্য’–এর কথা মনে পড়ছিল বারবার। মানসপটে অরণ্য, নিস্তব্ধতা, গাছের সারি কিংবা ঝিঁঝিপোকার ডাক। সাইকেল থামিয়ে চুপচাপ কান পেতে আছি। শালিকের ডাক কানে তীব্রভাবে লাগছে। ঘুঘুর ডাক খুব শান্ত, কিছুটা ব্যাকুল করছে প্রাণ। প্রকৃতির সঙ্গে নিজের যোগাযোগ আরও বাড়ানোর চেষ্টা! তাকিয়ে আছি লম্বা গাছগুলোর দিকে, যা পাহাড়ের বুকে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে। শুধু জানা হয়নি তাদের নাম। আবার একদিন আসব নাম জানতে, পরিচয় হতে, কথা বলতে।

ফরেস্ট্রির সকালে শুধু আমি আর প্রকৃতি। আবার কিসের নেশায় ধেয়ে চললাম গোলপুকুরের রাস্তা হয়ে শহীদ মিনারের দিকে। গোলপুকুর নিয়ে নানা মিথ প্রচলিত, যে কারণে স্থানটি আমার বেশ আগ্রহের। এক পাশে পাহাড়, এক পাশে পুকুর। পাশেই দাঁড়িয়ে লম্বা ইউক্যালিপ্টাস। দুই পাহাড়ের মাঝখানে পাকা রাস্তা। সাইকেলের তখন গতি ধীর; অরণ্য, গাছপালা, সতেজ নিশ্বাস।

হতাশার মোড় পেরিয়ে প্রীতিলতা হল। পাকা রাস্তায় শুয়ে আছে কুকুরের দল। আমার মুখপানে চেয়ে আছে। তাদের সঙ্গে দেখাদেখি, কিছুটা ভাবের চেষ্টা। অতঃপর আবার চলা। লেডিস ঝুপড়ি! সে তো পুরোটা পাখিদের দখলে। সবাইকে ছাড়িয়ে শালিকেরা আধিপত্যে। রাস্তার দুই পাশে লম্বা উঁচু গগনশিরীষ মাথায় ঝাঁকড়া চুলের মতো পাতা। এ গাছের বিশালত্ব আমার কাছে বিস্ময়!

শহীদ মিনার, বুদ্ধিজীবী চত্বর কিংবা জয়বাংলা ভাস্কর্য—ঘন কুয়াশা ডেকে রেখেছে সব। তার ভেতর দিয়ে আবার পূর্বদিকে ধেয়ে চললাম। সেই চিরচেনা কাটা পাহাড়, রাস্তায়। কণ্ঠে দরদ দিয়ে সুর তুলেছি দিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এ বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা;…।’

ততক্ষণে সকাল অনেকটা গড়িয়েছে। মধ্যবয়সী নর-নারীরা হেঁটে যাচ্ছেন। প্রাতর্ভ্রমণে তাঁরাও দল পাকিয়ে গল্প করছেন। ঢালু রাস্তায় গতি নিয়ে জিরো পয়েন্টে আসতেই আবার ভিন্ন দৃশ্যের দেখা! পুরো ক্যাম্পাসের কাকের হেডকোয়ার্টার রেলস্টেশন মাতিয়ে রেখেছে তারা। স্টেশনের প্রকৃত মালিক তারা, দিন–রাত দেয় পাহারা আর আমরা কেবল যাত্রী হয়ে আসি–যাই...।

কার্যনির্বাহী সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা