বন্ধু রবে হৃদয় স্পন্দনে

ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্রের আসরে বই পড়ছেন বন্ধু আল-ইসলাম। ছবিটি এখন কেবলই স্মৃতিছবি: সংগৃহীত

২০১৬ সাল, ভৈরব বন্ধুসভার জাগরণের সময় বলা যায়। একঝাঁক তরুণ-তরুণীর আবির্ভাব। নিয়মিত পাঠচক্র আয়োজন। ছোটখাটো আয়োজন চলমান; কিন্তু সবার স্বপ্ন এক বড় উৎসব করার। বন্ধু উৎসব অর্থাৎ বন্ধুমেলা-২০১৬। হঠাৎ এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য সাতপাঁচ না ভেবে দায়িত্ব বণ্টনসহ কমিটি গঠন হয় যে বাড়িতে, সে বাড়িটি আল-ইসলাম ভাইয়ের। তখন থেকেই আল-ইসলাম নামটি শুনে আসছি।

আমিও যখন ভৈরব বন্ধুসভায় ধীরে ধীরে নিয়মিত হই, সবার মধ্যে মধুর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সাংগঠনিক চর্চা নিজের মধ্যে আয়ত্ত করার চেষ্টা। সব সময় আল-ইসলাম ভাই পরিপাটি, দেখতে স্মার্ট এবং যখন কথা শুরু করতেন, তখন শ্রোতাকে মোহিত করে রাখতেন। বিশেষ ভালো লাগার কারণ, সব সময় সৎ পরামর্শ দিতেন তিনি। পাঠচক্রে মুদ্রিত বই নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা ছিল তাঁর।

আল-ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ‘একটি ভালো কাজ’ উপলক্ষে আমরা যাই কুলিয়ারচর উপজেলার ‘চকলেট পাঠশালায়’ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে। ফেরার পথে ছয়সূতী ইউনিয়নের নাছিরাকান্দা পথ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই দিকে আমার নানুর বাড়ি।’ আমিও বললাম, আমার নানুর বাড়িও এই পথ ধরেই। কথায় কথায় জানতে পারলাম, আমরা খালাতো ভাইবোন। আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। তার পর থেকে ওনার সঙ্গে আমার সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যখনই সুযোগ হতো, তখনই সাংগঠনিক চর্চা, পড়াশোনা ও পরিবার কীভাবে মেইনটেইন করব, সেই উপদেশ দিতেন।

২০১৭ সালের বন্ধুমেলায় আমরা সাংস্কৃতিক আয়োজনে প্রয়াত মহানায়ক স্মরণে ‘রাজ্জাক ইভেন্ট’-এ একসঙ্গে কাজ করি। বাংলাদেশের পড়াশোনা শেষ করে চলে যান সুদূর জার্মানিতে পড়তে। ২০২১ সালে ভৈরব বন্ধুসভা ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটির ওপর ঈদ আনন্দ ভিডিওচিত্রে জার্মান থেকেও যেন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন—এই নিয়ে কথা হয়। ঈদ শুভেচ্ছা বার্তা জানান জার্মান থেকে। কতশত স্মৃতি।

সবাইকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে ১০ এপ্রিল আল-ইসলাম ভাই কাউকে না জানিয়ে জার্মানি থেকে দেশে ফিরে আসেন। হঠাৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে পরিবারের সবার সে কী আনন্দ! মুহূর্তগুলোর সুন্দর ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে শেয়ারও করেন। ইচ্ছা ছিল আপনজনের সঙ্গে ঈদ করে আবার শিগগিরই জার্মানি ফিরে যাবেন।

বিবাহ করেছেন খুব বেশি দিন হয়নি। এবারই প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করলেন। ২১ এপ্রিল তারঁ স্ত্রীসহ পরিবারের সঙ্গে কিছু ছবিসহ ক্যাপশনে লিখেন, ‘আমাদের গত দিনগুলো ছিল দুর্দান্ত ও স্মরণীয়। এ যাত্রাটি সত্যিই আবেগ, মজা, যত্নশীল এবং আরও অনেক কিছুতে পূর্ণ ছিল...। আমার হৃৎস্পন্দন ক্রমেই কমছে এবং আমি জানি না কীভাবে আপনাকে এই সময় বিদায় জানাব...। স্মৃতির চেয়ে সময় দ্রুত উড়ে যায়।’

এই কথাগুলো তিনি লিখেছেন জার্মানিতে ফেরার দিন ক্রমেই কাছে এসেছিল বলে। আসলেই কি কাছের মানুষ এবং দেশ ছেড়ে দূরে যাবেন বলে লিখেছেন, নাকি পৃথিবীর মায়া থেকে দূরে যাচ্ছেন যে বুঝতে পেরেছিলেন?

পরদিন রাতে বন্ধুদের সঙ্গে যান ভৈরব বাজার লঞ্চঘাটে। ভৈরবের অনেক ছেলেরাই যায় মেঘনার তীরে আড্ডা দিতে। কিন্তু এই রাতেই তিনি আবারও চমক দিলেন সবাইকে! শুধু পরিবার নয়, পুরো ভৈরবকে চমকে দিলেন। লঞ্চে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান নদীতে। ৪০ মিনিটের অধিক সময় পর খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর নিথর দেহ। মা-বাবার মুখে শুধু একটাই কথা, বাবা তুই একি সারপ্রাইজ দিলি! পরিবার, বন্ধু, সাংগঠনিক সহকর্মী—সবাই কাঁদছে, চেয়েও ফিরিয়ে আনতে পারছে না।

সভাপতি, ভৈরব বন্ধুসভা