সুবর্ণ এক্সপ্রেস

অলংকরণ: তুলি

২০ বছর আগের কথা। দিনটি ছিল আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস। ট্রেনের হুইসেল বাজার শব্দ। যাত্রীরা এখনো আসেনি, ট্রেনের বগিতে বসে গল্প লেখার চেষ্টা করছি। ট্রেন ছাড়ার কথা বেলা তিনটায়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়ির কাঁটা ছয়টার ঘরে মিলিত হতে চলেছে। হকার ও যাত্রীদের পদচারণে অনেক শব্দদূষণ হচ্ছে। লিখতে পারছি না। মনের জানালায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে এলোমেলো ভাবনা।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিচ্ছে, নরসিংদীতে মালগাড়ি লাইনচ্যুত। চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস বিলম্ব করবে। গোধূলিলগ্নে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। জোছনা ভাঙা রাত, লোডশেডিং। আকাশে ফানুস উড়ছে, বাড্ডা বৌদ্ধমন্দিরের দিক থেকে আসছে মনে হয়। পুরান ঢাকায় চলছে সাকরাইন উৎসব, আতশবাজি আর লাইট শো। কিছুক্ষণ আগে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণী তার প্রেমিকের মুখে রং লাগিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল! কাঁধের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করে কানাকানি করছে।

সুবর্ণ এক্সপ্রেসের যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফানুস দেখছে। হঠাৎ পেছন থেকে ‘এক্সকিউজ মি! আমার ক্যামেরায় একটি ছবি তুলে দেবেন?’ কওয়া নেই, বলা নেই, ধপাস করে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ আর ক্যামেরা হাতে ধরিয়ে দিল। ‘শোনেন, পেছনে আকাশে ফানুস উড়ছে, ওটাসহ নিবেন কিন্তু!’ চোখে কালো সানগ্লাস, মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেসটাও নিবেন।’ ‘নিশ্চয়ই!’ ক্লিক করে দিলাম কয়েকটা ছবি। খুব হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে থ্যাংকস দিয়ে বলল, ‘আমি জেনি। অসাধারণ তুলেছেন আপনি। বাংলায় পড়ছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছুটিতে বড় মামার বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম। ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি হবে মনে হয়। কী করেন আপনি ঢাকায়? নিশ্চয় সাংবাদিক–ফটোগ্রাফার—কী ভুল বললাম?’ ‘না, আমি ব্যাংকার।’ জেনির কণ্ঠ খুব মিষ্টি। চঞ্চলা হরিণী, গায়ে পড়ে বকবক করে যাচ্ছে। ‘ওহ, সরি! আপনার নাম জানা হয়নি।’ ‘আমি রশীদ।’ এবার জেনি চমকে উঠল। ‘আপনি আমার সঙ্গে মিথ্যা বলছেন কেন? আপনি পূর্বকোণে, আজাদীতে লেখেন, ঠিক?’

‘আপনার ছোটগল্পগুলো আমার ভালো লাগে। মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখেন। ব্যাংকার হয়ে এত ভাবনা এত প্রেম আসে! আপনার “জীবন্ত মূর্তি” লেখাটা আমার ভীষণ পছন্দ, অসাধারণ এক প্রেমের গল্প! শেষে আপনি পাঠককে কাঁদিয়েছেন। আচ্ছা, এটা কি আপনার জীবনের গল্প?’ ‘যাক, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। একসময় লিখতাম, ঢাকায় আসার পর লেখা হয় না। চাকরি নিয়ে ব্যস্ত।’

হঠাৎ মাইকে ঘোষণা এল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। সবাই দৌড়ে ট্রেনে উঠতে ব্যস্ত। তিনটার ট্রেন রাত নয়টায় ছাড়ল। সিটে গিয়ে বসলাম। জেনিকে দেখলাম না। ‘বাই’ বলে কোথায় হারিয়ে গেল। ‘ঠ’ বগিতে গিয়ে ৭ নম্বর সিটে বসলাম। পাশের সিটটা খালি। ল্যাপটপ বের করে ‘চট্টল শিখায়’ একটা ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করছি ‘কবি ও শেষ ট্রেন’। বিষয় খুঁজে পাচ্ছি না, কী লিখব। ভাবনাগুলো এলোমেলো। একটু পর হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাগ নিয়ে হাজির জেনি। ‘ভাইয়া, আমি ভুলে ট বগিতে উঠে গিয়েছিলাম। আমার সিট ৮ নম্বর, আপনার পাশে। ভালোই হয়েছে।’ জেনি বসে পড়ল। লেখার মনোভাবটাও নষ্ট হয়ে গেল।

জোসনার আলোতে আলোকিত পৃথিবী। কয়েকটা জোনাকি পোকা লুকোচুরি খেলছে। জেনি বলল, ‘চট্টগ্রামে কদিন পরপর যাওয়া হয় আপনার?’ ‘এই তো মাসে দু–তিনবার। বাড়ি থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে, আম্মার শরীর খারাপ। অফিশিয়াল ট্যুরও আছে। সে জন্য আজকে যাচ্ছি।’ জেনি বলল, ‘আপনি তো হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র। লেখালেখি, জব, সংগঠন—এত কিছু কীভাবে সামলান?’ ‘ব্যাংকে ঢুকে সৃজনশীল কাজকর্ম করা কঠিন। নিজের ভালো লাগাটুকু সব কবর দিয়েছি।’ সাহিত্য–সংস্কৃতি, প্রকৃতি উপভোগ, চাটগাঁ—বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ জমে উঠল কথামালা। ভোররাত চারটায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস সীতাকুণ্ডে এসে আবার থেমে গেল। পাহাড়ের আশপাশে কিছু নিবু নিবু বাতি জ্বলছে। নীল নির্জন রাতে ঝিঁঝি পোকা গেয়ে চলেছে। দূরে কোথাও যেন গহিন অরণ্যে ‘চিঁহি পাকে’ ডাকছে ‘চিঁহি চিঁহি’। জেনিকে বললাম, ‘আপনি আবৃত্তি শোনান।’ ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আবৃত্তি করা শুরু করলেন জেনি। পুরো বগিতে সবাই ঘুমিয়ে আছে। কেবল জেগে আছি আমি আর জেনি। আকাশজুড়ে তারার আলো। চমৎকার আবৃত্তি করে জেনি। আবৃত্তি শুনে একটা অজানা ভালো লাগা কাজ করছে তার প্রতি। অপরিচিতা ক্ষণিকের অতিথির মতো মেয়েটাকে খুব কাছের মনে হলো। জেনি আবৃত্তি শেষ করে বলল, ‘এবার আপনি একটা আবৃত্তি করেন।’ ‘আমি কবিতা জানি না, আবৃত্তিও পারি না। ঠিক আছে, রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতা আমার খুব পছন্দের। “The woods are lovely dark and deep but I have promise to keep and miles to go before I sleep and miles to go before I sleep.”’ রাতভর জেনির গল্প শুনলাম। শরীরে এখনো ক্লান্তি আসেনি।

জেনি ঘুমিয়ে পড়েছে। তার কালো কেশরাশি মুখের ওপর দুলছে। চাঁদের আলো এসে চুমিয়ে যাচ্ছে কপাল। ফরসা, অপরূপা, মায়াবী চেহারায় চাঁদের দেশের জীবন্ত মূর্তির মতো লাগছে। জেনির মাথা এখন আমার বুকে। আহা! জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে আরেকটা কবিতা রচনা হতো ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেসে বনলতা সেন’। হুইসেলের শব্দে জেনির ঘুম ভেঙে গেল। কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘সরি, সরি।’ আকাশের পেট ছিঁড়ে সূর্য উদিত হতে চলেছে। সূর্যের লাল আভা জানালার ফটক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চট্টগ্রামে এসে সুবর্ণ এক্সপ্রেস থেমে গেল।
এই একটা ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে সেতুবন্ধন রচনা করছে। ট্রেন থেকে নামার সময় জেনি নামতে পারছিল না, তাকে হাত ধরে নামিয়ে দিলাম। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, ভালো লাগার কথাটা বলে ফেলি। সে ট্রলি নিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। পিছু পিছু দৌড়ে গেলাম। ‘এই শুনছ।’ একবার ইচ্ছা করল, না সাহস করে বলেই ফেলি ভালো লাগার কথাটা! কথাটা বলা হয়নি। কত গল্প, কত অজানা কাহিনি রচনা হয় এই সুবর্ণ এক্সপ্রেসে। জেনিকে বিদায় দিয়ে সিএনজি নিয়ে চলে যাই দেব পাহাড়ের বড় দাদার বাসায়। গিয়ে দেখি, আম্মা সুস্থ আছেন, মালিহা, কান্তার সঙ্গে গল্প করছেন। মালিহা বলল, ‘চাচ্চু, আপনার লেজ কাটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’ অবাক কাণ্ড! আমাকে না জানিয়ে!

পাত্রী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। বুকের মধ্যে অজানা শিহরণ। কান্তা এসে কানে কানে বলল, ‘চাচ্চু, মেয়েটা তোমার সঙ্গে ভালো মানাবে, শিল্পকলায় আবৃত্তি করে। লেখালেখিও করে নাকি। প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছে। ঢাকা থেকে ফেরার কথা। মেয়ের নাম কী, বাড়ি কোথায়? এখনই বলা যাবে না। আজকে সবাই মিলে দেখতে যাওয়ার কথা। উনি নাকি বড় মামার বাসায় বেড়াতে গেছে। ফেরার কথা সুবর্ণ এক্সপ্রেসে।’ অদ্ভুত সবকিছু কেমন মিলে যাচ্ছে!
বায়োডাটার ছোট একটা হলুদ খাম পড়ে আছে টেবিলে। খামটা হাতে নিয়ে ভাবছি, এটা খুলব কি না। খাম খুলে অবাক হলাম, পাশাপাশি বসে একসঙ্গে ফিরলাম চট্টগ্রামে। প্রথম দেখাতে কত কাছের, কত আপন মনে হলো তাঁকে। না, এ মুহূর্তে বিয়ে করা অসম্ভব। সবাইকে রাগ করে বললাম, ‘আমি মেয়ে দেখব না।’ একসময় রেগে বললাম, ‘তোমরা যা ভালো মনে করো, তাই হবে।’ বড় ভাবি বলল, ‘তোমার পার্টনার তুমি দেখবা না? পছন্দের থাকলে বল।’ ‘না ভাবি, ট্রেনে একটা মেয়েকে হঠাৎ ভালো লেগেছে একেবারে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র নায়িকার মতো। কিন্তু তাঁর ফোন নম্বর, বাসার ঠিকানা—কিছুই নেওয়া হয়নি। ক্ষণিকের বন্ধুত্ব, ভালো লাগা আমার ছোট গল্পের ভক্ত।’ নীল খামটা চোখের সামনে খুলতে গিয়ে খোলা হয়নি। জেনির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা