প্রেম নিবেদনে চিঠির যুগের একেবারে শেষের দিকের মানুষ আমি। তা–ও সেটা স্কুলে পড়ার সময়ের কথা বলছি। সেই সময়ের প্রেমের ধরন, গভীরতা ছিল অন্য রকম। চিঠির যুগ পেরিয়েছে সেই কবে। সময়ের সঙ্গে প্রেমের আবেদনও বদলেছে। এখনকার প্রেমের স্থায়িত্ব কম, আবার খুব ক্যালকুলেটিভ। এই ক্যালকুলেটিভ প্রেমের যুগে আমার এমন এক জুটির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, যাদের দেখে দীর্ঘদিন পর মনে হয়েছে, প্রেম সবকিছুর ঊর্ধ্বে, প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয়, প্রেমের শক্তি অপরিসীম। নিখাদ ভালোবাসা না থাকলে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানো যায় না। এই অনিশ্চয়তা জীবন–জীবিকার নয়, এই অনিশ্চয়তা জীবনের।
তাদের সঙ্গে আমার দেখা দেশের বাইরের একটি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে। আমার আব্বু তখন অপারেশন থিয়েটারে। আমি বাইরে বসে আছি। পাশের বেঞ্চে বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন একটি মেয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। বয়স ২৩ কি ২৪। মুখটায় এত মায়া, চোখ দুটো দেখে বোঝা যায়, দীর্ঘদিন ঘুমায়নি। একধরনের তীব্র অনিশ্চয়তার ছাপ তার মুখে। আমি জানতে চাইলাম, কে আছে হাসপাতালে? বলল, তার স্বামী। দুজনই আছি রোগীর অপেক্ষায়।
অপারেশন থিয়েটারে একসঙ্গে তিন–চারজন রোগী নেওয়া হচ্ছে, স্ক্রিনে রোগীর ডিটেইলস উঠছে—কে কোন অবস্থায় আছে। গল্প বলা শুরু করল মেয়েটি। তাদের প্রেম সাত মাসের। তুমুল প্রেমে যখন দুজন মগ্ন, দুর্দান্ত সময় কাটছে, নতুন স্বপ্ন সাজাচ্ছে, সেই সময় জানতে পারল, ছেলেটি জটিল রোগে আক্রান্ত। জীবন–মরণের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে, সেটাও অনিশ্চিত যে সে সুস্থ হবে কি না। ছেলেটি মেয়েটিকে মুঠোফোনে একটা বার্তা পাঠিয়েছিল, ‘এই সময়ে তুমি চলে গেলে যে কদিন বেঁচে থাকব, তার আগেই আমি মরে যাব। এই অল্প দিনের জন্য তোমার সঙ্গ আমার খুব প্রয়োজন।’
মেয়েটির নাম ঐশানি। ঐশানি নামের অর্থ হলো, শক্তির প্রতীক। দেবী দুর্গার আরেক নাম ঐশানি। ভীষণ মানসিক দৃঢ়তাসম্পন্ন এই মেয়ে সাত মাসের পরিচয়ে অভীক নামের ছেলেটিকে বিয়ে করে পরিবার ছেড়ে সেই মুহূর্তে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে সময় গুনছে। ২১ দিনের মতো আমি সেখানে ছিলাম। ঐশানি দেবী দুর্গার মতোই অভীককে আগলে রেখেছে। প্রতিটি দিন ওর জন্য একেকটি চ্যালেঞ্জ। পরিবার সঙ্গে নেই তার। নতুন পরিবারের মানুষদের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়াটাও ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জ। অভীকের পরিবার ঐশানিকে শুরুতে ভালোভাবে নেয়নি।
সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বিভোর ঐশানিকে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে এখনো হচ্ছে। ঐশানির বাবা নেই। আমরা যে কদিন ছিলাম মেয়েটি আমার বাবার আরেকটা মেয়ে হয়ে উঠেছিল। মানুষকে আপন করে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতা ওর আছে। ওর ভেতর এমন এক প্রাণশক্তি আছে যা আশপাশের মানুষদের স্বস্তি দেয়। আমার মনে হয়, ঐশানির জীবনীশক্তির বলেই অভীক এই অবস্থা থেকে ফিরে এসেছে। এখনো লড়াই করছে। কতটা মানসিক শক্তি আর প্রেম থাকলে একটা মেয়ে সব জেনে এভাবে পথ চলতে পারে, সেটা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এমন একজন ঐশানি প্রয়োজন সবার। যে নিজের প্রেম, ভালোবাসা ও সম্মোহনী শক্তি দিয়ে সবাইকে আগলে রাখবে।
আমরা চলে আসার পরও তারা সেখানেই ছিল। প্রায় ছয় মাস থাকতে হয়েছে তাদের। এই লেখা লিখতে বসার আগে ঐশানিকে কল দিয়েছিলাম। জানলাম, ২ দিন হলো আবারও অভীককে নিয়ে ও বিদেশের সেই হাসপাতালে আছে। জীবনযুদ্ধ এখনো তাদের শেষ হয়নি। তবু স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছে অনিশ্চয়তার ভালোবাসাকে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য।