ক্যানভাসে কেন ভাসে

নিজ জীবনের সঙ্গে মানানসই লেখাটির পাঠকের দোদুল্যমান হৃৎপিণ্ডের ঝোড়ো স্পন্দনের মতো কখনো কখনো লুকোচুরি খেলে প্রহরেরা। কোনো এক কোনায় পড়ে থাকা, প্রেমিকার দেওয়া বহু পুরোনো; কিন্তু এখন আর না চলা হাতঘড়ির মতো—যেন গভীর রাতে থেমে থাকা মহাবিশ্ব, যেখানে অস্তিত্ব আর অস্তিত্বহীন মিশে আছে একসঙ্গে।

নিত্যদিনে চিত্তবীণে সুরের মূর্ছনা আর ঝংকার না তোলা মনপাড়ার অনিকেত দেয়ালজুড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে যেন নীলাভ সবুজ শৈবালের মতন পটাশিয়াম সায়ানাইডের প্রতিক্রিয়া। ঘনঘোরলাগা অভিমান-অভিযোগের ক্ষণে একই বালিশে দুদিকে দুমাথা রাখা দম্পতি যেমন বিভীষিকাময় রাত্রির সাক্ষী, তেমনি কবিতারাও আজকাল অভিমানের পসরায় দেয় অস্তিত্ব জানান। বাস্তবতা-অভিনয়ের সাংঘর্ষিক জাঁতাকলে ঘাবড়ে যাই দিনমান, হাসি ফোটাতে চাওয়ার ইচ্ছারা যখন দাবি করে বসে এক অশ্রুফোয়ারা। অথচ এমনই এক সময়ে গাল জানে না সিক্ততার ইতিবৃত্ত কতটা উৎকণ্ঠার।

বদলায় না শুধু আমার শূন্য ঘরে একলাদুপুরে মৃদুআঁচে ভাজা ডিমভাত খাওয়ার প্রতীক্ষা, প্রচণ্ড চাপা অনুভূতিতেও মুচকি হাসির উপস্থিতি, আব্বার কত বছরের পুরোনো শার্ট, আম্মার বিয়ের শাড়ি।

সময় শিখিয়ে দিয়েছে এমতাবস্থায় নীরবতাই শ্রেয়। নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ দিতে বারংবার নিকটে আসে রোজনামচা। ঘচঘচ করে লেখা হয়ে যায় কত কিছু, শুভ্র কাগজ সাক্ষী হয় শূন্যতার-বিষণ্নতার। হলদে খামে প্রাপকহীন কোনো এক ঠিকানায় জমা হয় পত্রগুলো কবিতাঠাসা খাতায়, বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে, নোটবুকের ভাঁজে ভাঁজে কিংবা ভুলে যাওয়া কোথাও। শতসহস্র  সুখস্মৃতি, দুর্বিষহ মুহূর্তের দর্শক ওরা। যেকোনো সময় আহ্বান করলে সাড়া পাওয়া যায় ওদের। ছুটির দিনে হোক কিংবা তুমুল ব্যস্ততার ফাঁকফোকরে, ওরাই ভীষণ মুগ্ধ শ্রোতা। নেই কোনো বিরক্তি-একঘেয়েমি কিংবা বিন্দুসম অস্বস্তির ছিটেফোঁটা। ওদের কাছে বদলাই না আমরা।

সবকিছু বদলে যায়। আমাদের বিচরণভূমি, মুখাবয়ব, বন্ধুমহল, শহরের অলিগলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডি। সময়ঘড়ির আবর্তনে বদলাতে থাকে বর্ষ-ঋতু-যুগ-শতাব্দী। বদলে যায় মানুষ-স্মৃতি-প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতিও।

রাজ্যের রাজসিংহাসনে বসতে থাকা অবস্থায় বদলে যায় মহারাজের তার প্রজার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য, রদবদল হয় শাসনকার্যের। প্রজাদের শোষণ-নিপীড়ন ও সত্যকে সত্য বলা এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার অপরাধে স্থান হয় পদতলে, নিম্নস্থানে, চাবুকের তলে, কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে; যেখানে তার অপরাধ সত্যের সন্ধানে সে অটল আর মিথ্যার সমতল দর্পণে দেখে না প্রতিবিম্ব। তবু বারবার প্রশ্ন জাগে মনে। মিথ্যা বলে কাউকে মাতিয়ে রাখার চেয়ে সত্যি বলে অপরাধী হওয়াটাই শ্রেয় নয় কি?

অনেকের কাছে ভালোবাসা মরে যায়, পচে যায়, বিদঘুটে গন্ধও ছড়ায়। লোডশেডিংয়ের অমাবস্যা নিশির মতন কুচকুচে কালো, যেন কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে ভারি সখ্যতা তার। ভালোবাসা বিটার ব্র্যাকেট ফাঙ্গাসের চেয়েও ভীষণ তেতো হয়ে যায়, মুখে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন বমি আসে।

ভালোবাসায় ধূলা জমে যায়, আগের চেয়েও ভীষণ কমে যায়। বর্ষার মনখারাপ করা দিনেও যেমন মেঘরাশি দূর অজানায় ভেসে যায়, তেমনি ভালোবাসাও হয়ে যায় চিরচেনা থেকে চির অচেনা-অপরিচিত, যেন কখনো কিছু ছিলই না। ঝরাপাতার মতন শুকিয়েও যায়, লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে যায়, তবু রেখে যায় ধ্বংসাবশেষ-স্ফুলিঙ্গ।

ভালোবাসায় মোড় ঘুরে যায়, যোজন আলোকবর্ষ দূরে যায়, উদ্দেশ্যহীন জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়, হয়ে যায় বিরক্তিমাখা। কতই–না অবহেলার পরশে পায় নতুন নাম! আগের চেয়েও অনেকটা কম মূল্যের হয়ে পড়ে, হারিয়ে যায় বর্ণ, দেখতে হয় কুৎসিত। ওরা একা হয়ে যায়, নবরূপ দেখা হয়ে যায়, মানুষ চেনা শেখা হয়ে যায়, অনেকেরই ঠেকা হয়ে যায়, একটু বেশিই ন্যাকা হয়ে যায়, দূরত্ব তার বিন্দু হতে রেখা হয়ে যায়, প্রতিপাদ স্থানে যেন প্রত্যাবর্তন হয় ওদের। নতুন করে গল্প লেখা হয়ে যায়, হয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। পরিবর্তনের সূর্যোদয়ে হয় ওদের পুনর্জন্ম। হয়ে যায় শ্বাসরুদ্ধকর, কয়েলের ধোঁয়ার মতন। বেশি বুঝতে বুঝতে অবুঝ হয়ে যায়, কত পথ খুঁজতে খুঁজতে নিখোঁজ হয়ে যায়। ছন্নছাড়া-মায়াহারা হয়ে যায়, নিষ্প্রভ হয় ওদের প্রখর আলো, কুয়াশাচ্ছন্ন, ঘোলাটে, দুঃখদ, দুঃসহ, দুঃশ্রব, দুঃসাধ্য, দুঃস্পর্শ হয় ওরা। চলে যায় ডুবন্ত ব্যক্তির ধরাছোঁয়ার অথই পানিতে যেমন হাতে নাগাল পাওয়া যায় না, তেমন দূরত্বে।

বদলায় না শুধু আমার শূন্য ঘরে একলাদুপুরে মৃদুআঁচে ভাজা ডিমভাত খাওয়ার প্রতীক্ষা, প্রচণ্ড চাপা অনুভূতিতেও মুচকি হাসির উপস্থিতি, আব্বার কত বছরের পুরোনো শার্ট, আম্মার বিয়ের শাড়ি। এসব অপরিবর্তনের ছোঁয়া মিথ্যা নয়।

আবারও প্রশ্ন বিঁধে নিউরনে, ‘ক্যানভাসে কেন ভাসে বৃহস্পতিবারের স্মৃতিকথা, যেহেতু বদলেই গেছি?’

বন্ধু, জামালপুর বন্ধুসভা