সুইচ টিপলে বিছানা গরম

কাশ্মীরের ডাল লেকে হাউসবোট
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

হাউসবোট এত সুন্দর যে আনন্দে সবাই চিৎকার করে উঠল। আমাদের চিৎকার শুনে পাশের বোটের এক পরিবার এল। তারা এসেছে তামিলনাড়ু থেকে। স্বামী-স্ত্রী ও এক কন্যা। মজা করে বললাম, ‘ভাই সাহেব, আপনাদের তো কোর্স কমপ্লিট হয়নি। আরেকটা সন্তান দরকার।’ সবাই হেসে উঠল। শুরু হলো তুমুল গল্প, আড্ডা। বাদ যায়নি হামাস-ইসরায়েল, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধান্দাবাজি। ইউরোপের তাঁবেদারি। চীন, ভারত, রাশিয়ার পরাশক্তি হয়ে ওঠাসহ নানা বিষয়।

এভাবে কেটে গেল অনেক রাত। এদিকে প্রচণ্ড ক্ষুধায় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ধৈর্যের বাঁধ আর মানছে না। ওই পরিবারটিও চলে গেল। ডাইনিংয়ে খাবার প্রস্তুত। হুমায়ূন আহমেদের ‘এই সব দিনরাত্রি’ নাটকে দেখেছি একটা দৃশ্যে আনন্দ তো পরের দৃশ্যে দুঃখ। আসলে আনন্দ ও দুঃখ প্রায় এক থাকে। যার যখন প্রয়োজন, সে তখন সামনে আসে। এত উচ্ছ্বাসের মধ্যেও একটা দুঃখের ঘটনা ঘটল। হঠাৎ ফায়ারপ্লেসের পাইপে ছোঁয়া লেগে একজনের হাত পুড়ে গেল। তারপর যা হওয়ার তার থেকে কম কিছু হয়নি। তলস্তয়ের আনা কারেনিনা উপন্যাসে লেখা ছিল, আনন্দটা সবার। কিন্তু দুঃখগুলো যার যার মতো করে আলাদা। তাই যার হাত পুড়ে গেল, দুঃখটা শুধু তারই রইল।

আরও পড়ুন

দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই ড্রয়িং-ডাইনিং। ডাইনিংয়ে খাবার দেওয়া হয়েছে। সবাই খেতে গেলাম। মেনুতে ছিল আলু রুটি, ভাত, মাংস, কোফতা, ডাল, সালাদসহ আরও কিছু আইটেম। কাশ্মীরের রান্না অসাধারণ! একেবারে মায়ের হাতের রান্নার মতো।

হাউসবোটে অন্য পরিবারের সঙ্গে শেয়ারে থাকা যায়। আবার সম্পূর্ণ বোট ভাড়া নেওয়া যায়। ওই যে কবিতায় আছে ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচতে চায়’। দলনেতা চান সবকিছুতে যেন স্বাধীনতা থাকে। অর্থাৎ খরচে অকৃপণ। তাই সম্পূর্ণ বোট ভাড়া নিয়েছেন।

বেডরুমগুলোও স্বপ্নের মতো সাজানো। প্রতি রুমে সুন্দর পর্দা, ড্রেসিং টেবিল, ফ্লোরে কার্পেট, সুন্দর বিছানা। জীবনে প্রথম দেখলাম সুইচ টিপলে বিছানা গরম হয়। প্রতি বেডের সঙ্গে ইলেকট্রিক সুইচ আছে। সেটা টিপে দিলে বিছানা গরম হতে থাকে। বাথরুমে বাথটাব, ঠান্ডা-গরম পানি। হাউসবোটে কী আছে, এর চেয়ে বড় প্রশ্ন কি নেই! এত সুন্দর মনে হবে যেন কল্পনার একটি ভাসমান বাড়ি।

হাউসবোটের ড্রয়িংরুম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অনেক রাতে ঘুমিয়ে অনেক সকালে ওঠা হলো না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই বিস্ময়! গত সন্ধ্যায় বোঝা যায়নি কতটা বিস্ময় এখানে আছে। পানসি নৌকার মাথায় দাঁড়িয়ে অপার দৃশ্য দেখা যায়। সন্ধ্যায় এক রকম তো সকালে অন্য রকম। দলনেতাসহ যেকোনো কঠিন মানুষও এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে। যেদিকে তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়। লেকটা যে কত বড়, রাতে সেটা বোঝা যায়নি। যত দূর চোখ যায় তার পরেও লেক...।

দুপাশে সারি সারি অসংখ্য হাউসবোট। প্রতিটা বোটই নান্দনিক। নানা দেশ থেকে মানুষ ভ্রমণের জন্য এখানে এসেছেন। রঙিন শিকারায় তাঁরা হাউসবোটে যাচ্ছেন। লেকজুড়ে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য শিকারা। শিকারায় ভেসে লেক দেখা এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। মনে হবে এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ। আমাদের তখনো শিকারায় ভেসে এই সৈন্দর্য অবলোকনের সুযোগ হয়নি।

সবাই যা এক দিন পরে ভাবে। আমাদের দলনেতা সেটা এক দিন আগে ভাবেন। তিনি এক দিন আগেই দুটি শিকারা ঠিক করে রেখেছেন, যেন পুরো লেক ঘুরে এর ঐশ্বর্য উপভোগ করা যায়। এই লেক শুধু তার সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের পর্যটক ও স্থানীয় লোকজনের এক অপরূপ মিলনমেলা। অনেকে এই লেককে প্রাচ্যের ভেনিস বলে। শিকারায় ভাসতে ভাসতে দেখা যায় মেঘ, পাহাড় ও রোদের খেলা। অনন্য বৈচিত্র্যে ভরা এর প্রকৃতি।

চলবে...