রাতের শাটল ভ্রমণ

রাতের শাটল ভ্রমণছবি: সংগৃহীত

মনে হচ্ছে, মস্ত অজগরের ওপর বসে আছি। এঁকেবেঁকে চলছে, হলদে আলো প্রজ্বালিত করে জোরে হুইসেল বাজিয়ে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা, শীতল বাতাস গায়ে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে।
ষোলশহর জংশন থেকে শাটল ছেড়ে শহর পেরিয়ে চলছে। আমি ছাদে বসে পুরো ট্রেনের গতিময়তা দেখছি। বাঁক নিচ্ছে, আবার সোজা হয়ে চলছে। দুই পাশে গিঞ্জি পরিবেশ। লাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট্ট বসতি। রেললাইন আর রেলের সঙ্গে এ বসতির মিতালি প্রতিনিয়ত। ছাদে বসে মস্ত ভবন যেমন দেখছি, আবার দেখছি লাইনঘেঁষা বাঁশ–টিনের এই ঝুপড়ি ঘর।

নানান হাবিজাবি ভাবছি, ট্রেন চলছে। ইঞ্জিন ধোঁয়া ছেড়ে গতি বাড়াচ্ছে। শহরের বসতি পেরিয়ে ততক্ষণে দুই পাশে গাছের ছাউনির ভেতর দিয়ে চলছি। হলদে হেডলাইট পথ দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড বেগে বনের ভেতর যেন মস্ত দানব ছুটে যাচ্ছে। এদিকে গাছের পাতার ঝাপটা থেকে বাঁচার জন্য আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তীব্র গতিতে এই ভয়ংকর অনুভূতি।

রাত অনেক হয়েছে, শহরের বসতবাড়ি কমেছে, খোলা মাঠ চোখে পড়ছে। শীতল বাতাসে দোল খেয়েই চলছি। হাওয়ায় ভাসছি, যেন স্বর্গীয় দোলনার দোল! এই ছুটে চলায় নানা ভাবনায় উদ্রেক। কেউ কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনছে, কেউ হাতে বাদাম টিপে চলছে। এসব তরুণের মনমগজে কত কী! জীবনের তাগিদে টিউশনি করিয়ে আবার ফিরছে পাহাড়িয়ার ক্যাম্পাসে।

এখানে জীবনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও কত মায়া। শূন্য পকেট, ক্ষুধার্ত পেট, ক্লান্ত শরীর; তবু দুঃখ নেই! এই যে ফেরার মুহূর্ত, হঠাৎ হঠাৎ হুইসেল, ট্রেনের চাকার ঝনঝন শব্দ যে–কাউকে গভীর ভাবনায় নিয়ে যাবে। প্রতিমুহূর্তে শাটল এগিয়ে চলছে। ক্ষণিক পরপর একেক রকম পরিবেশ ধরা দিচ্ছে। ক্যান্টনমেন্ট পেরুতেই পশ্চিমের ভাটিয়ারির পাহাড়সারি বুক উঁচু করে ডাকছে। রাতের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য মনটাকে মোমের মতো নরম করে তুলছে।

পুরো পথ দেখতে দেখতে এসেছি। কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই ভয়ংকর সৌন্দর্য দেখেছি। আমার সুইজারল্যান্ড কিংবা ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ নেই। পৃথিবীর অনেক সৌন্দর্য এখনো দেখা বাকি। তবু আমার মায়াময় শাটল ভ্রমণের রাত, আমার কাছে কম কিছু নয়। এতেই প্রচণ্ড সুখ নিংড়ে নিচ্ছি।
ফতেহাবাদ পার হওয়ার পর মনে হয়, আপন নীড়ে চলে এসেছি। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি আসতে দুই পাশের জলাশয় দূরে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকা চবির পাহাড় আরও তীব্র আনুভূতির সৃষ্টি করে। শাটলের ছাদ থেকে দক্ষিণ ক্যাম্পাসের উঁচু দালানগুলো কত ছোট মনে হয়। ভবনের রাতের আলো মনে হয় পাহাড়ের বুকের কারুকার্য। ছোট্ট ব্রিজ, যাকে আমি নাম দিয়েছি লন্ডন ব্রিজ, তাতে ইঞ্জিন প্রবেশ করলেই উঠে দাঁড়াই। আমার যে নামার সময় হয়েছে...

এই ভ্রমণ, এই বাতাসের দোল আমার মনমগজে নেশার ঘোর ধরে রেখেছিল। শাটল থেকে নামলে এ আরেক পরিবেশ। স্টেশনজুড়ে আড্ডা, চা–চক্র গানের আসর, প্ল্যাটফর্মে গল্পের পসরা, এই তো! আপাতত এই সুখানুভূতি নিয়ে ব্যাচেলর সংসারে ফিরে যাই...

কার্যকরি সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা