ক্যাম্পিং, বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঝরনা

চট্টগ্রামে পৌছানোর পর বৃষ্টি বরণ করে নেয়!
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, ক্যাম্পিং করব। সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এই তো সেদিন, হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মিলে ঠিক করে ফেললাম, এবার ক্যাম্পিং করব। তাঁবুতে রাত্রিযাপন, পাশাপাশি পাহাড়-ঝরনার অনিন্দ্য দৃশ্য উপভোগ করা। যেই কথা সেই কাজ।

৩ আগস্ট। দিনটি ছিল রোববার। ছয়জনের ছোট্ট একটি বহর। গন্তব্য ঝরনার স্বর্গখ্যাত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই। রাত বাজে তখন ১১টা। ঢাকার কমলাপুর থেকে ছয় বন্ধু মিলে ট্রেনে রওনা হই চট্টগ্রামের উদ্দেশে। তূর্ণা এক্সপ্রেস, হুইসিলের বাঁশিতে ঝনঝনিয়ে ছুটে চলেছে আপন গতিতে। এদিকে জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে যেন চাঁদের রানি পৃথিবীতে অবতরণ করেছে। অপরূপ দৃশ্য! সেই দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দুচোখে গভীর ঘুমের অলসতা ভর করে বসল।

রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই ট্রেন পৌঁছে যায় চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। এরই মধ্যে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। তবে বৃষ্টি আমাদের রোমাঞ্চে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ছুটে চললাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। বাসে চেপে চলে এলাম সীতাকুণ্ড বাজারে। সেখান থেকে শুরু হয় আমাদের চন্দ্রনাথ বিজয়ের এক রোমাঞ্চকর যাত্রার। সমতল ভূমি থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এদিকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাটির সিঁড়ি ও হাঁটার সরু পথগুলো বেশ পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সামান্য ভুল করলেই সোজা ১ হাজার ১৫২ ফুট নিচে পাহাড়ের খাদে! অবশ্য চন্দ্রনাথের চূড়ায় উঠতে শেষ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি।

চূড়ায় ওঠার পর সবার আগে চোখে পড়ে সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ মন্দির। আকাশে সাদা মেঘের দল দেখে মনে হচ্ছিল যেন আকাশ নিজেই নেমে এসেছে পাহাড়ে! যে যার মতো ছোটাছুটি করছে মেঘগুলো। চারদিকে সবুজের সমারোহ। মনে হচ্ছিল, কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতে রংতুলিতে আঁকা দৃশ্য।

ক্যাম্পিং স্থানে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দিনের দ্বিতীয় ভাগে আমরা সীতাকুণ্ড বাজার থেকে ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে চললাম সোনাইছড়িতে, বহুল প্রতীক্ষিত ডিয়ার ক্যাম্পে। এখানকার সবচেয়ে সুন্দরতম ক্যাম্প এটি। ক্যাম্পটির অবস্থান মিরসরাই উপজেলার রড়তাকিয়া রেলস্টেশনের পূর্ব সোনাইছড়ি গ্রামের শেষ প্রান্তে। ক্যাম্প থেকে সবুজে আচ্ছাদিত বিশাল বিশাল পাহাড়, ঝরনা ও লেক সহজেই অবলোকন করা যায়।

বিকেল থেকে শুরু হয় ক্যাম্পিং। বিকেলের নাশতা হিসেবে ছিল নুডলস, চা, বিস্কুট। পাহাড়ের ঝুম বৃষ্টির সঙ্গে বেশ মানানসই বটে! এদিকে সবাইকে উজ্জীবিত করতে চায়ের চুমুকে গানের সুর তুলল বন্ধু আবদুল্লাহ বিন কাফি। আমরাও তার সুরে গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলাম। বেশ জমজমাট পরিবেশ। কয়েক ঘণ্টা টানা বৃষ্টির পর রাতের খাবার খেতে তাঁবুতে গেলাম। প্রতি তাঁবুতে দুজন করে মোট তিনটি তাঁবু রাখা হয়েছে। আর ক্যাম্প গাইড হিসেবে ছিলেন মিরাজ ভাই।

সোনাইছড়ি ঝরনাতে লেখক ও তাঁর বন্ধুরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বৃষ্টির রাত হওয়ায় বারবিকিউ করা আর সম্ভব হয়নি। টিম মেম্বার সবাই পাহাড়ে চড়ে বেশ ক্লান্তও! এদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও অন্ধকার বেড়েই চলছে। ক্যাম্পের চারপাশে কয়েকটি হারিকেনের আলো মিটিমিটি করে জ্বলছিল। ক্যাম্প ফায়ারিং না করলে তাকে তো আর ক্যাম্পিং বলা যায় না! তাই দেরি না করে, আমি ও সুজন মিলে খড়ের তৈরি একটি ছাউনির নিচে ক্যাম্প ফায়ারিংয়ের প্রস্তুতি নিলাম। একে একে সবাই চলে এল। আমি, সুজন ও শাহজাদা হারিকেন ও টর্চ হাতে ক্যাম্পের আশপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম যে সাপ-বিচ্ছু আছে কি না। রাতও গভীর হচ্ছে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ি বন-জঙ্গল থেকে বিভিন্ন জন্তুর ডাক বাতাসে ভেসে আসছিল। ভয়ে শাহজাদা বলল, ‘দোস্ত অনেক রাত হয়েছে। এদিকে জঙ্গল থেকে জীবজন্তুর আওয়াজ আসছে। চল তাঁবুতে ফিরে যাই।’

সিদ্ধার্থ, কাফি ও ফাহিম ফায়ারিং বেশ উপভোগ করছে। কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। দূর আকাশপানে চেয়ে দেখি, কিছু কালো মেঘ চাঁদকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। তবু কালো মেঘকে ফাঁকি দিয়ে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। এ যেন চাঁদ ও কালো মেঘের লুকোচুরি খেলা। অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় চারদিকের পাহাড়ি ঝরনাগুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে, পাহাড় থেকে ভেসে আসছে ঝরনার মধুর শব্দ। রাতের শেষ ভাগে আবার শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। এবার বাধ্য হয়েই ফায়ারিং ছেড়ে তাঁবুতে চলে যেতে হলো। সারা দিন বেশ পরিশ্রম গেছে। মাথা বালিশে রাখতেই চোখ দুটি ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙতেই চোখ পড়ল ঘড়িতে। ভোর ছয়টা বাজে। রাতভর বৃষ্টি হওয়ায় লেক পানিতে পুরো টইটুম্বুর হয়ে গেছে। যদিও আকাশ পরিষ্কার মনে হচ্ছিল; তবু পাহাড়ি অঞ্চলে কখন বৃষ্টি নামে, তার ঠিক নেই। সবাই ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে চললাম ক্যাম্পের পাশেই সোনাইছড়ি ঝরনাতে। বিশাল উঁচু পাহাড়। মিনিট ১০ নৌকা বেয়ে চলে গেলাম ঝরনার পাদদেশে, রাতে হয়তো এই ঝরনার তীব্র আওয়াজ শুনেছি। সবাই ঝরনার সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদিকে আকাশে আবার কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে এসে সকালের নাশতা শেষ করে ক্যাম্প ত্যাগ করি।
রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি।

ম্যাগাজিন সম্পাদক, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা