সাক্ষাৎ

অলংকরণ: তুলি

ঘুম হতে উঠেছি সকাল সাড়ে আটটার দিকে। একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। প্রবাসে দীর্ঘ সময়ের একাকী বিষণ্ন জীবনে পরিবারের বাইরের একটা মানুষ দিয়ে গেছে তার অফুরন্ত সমর্থন, ভালোবাসা। মুখবইয়ে পরিচয় হলেও মানুষটাকে চিনি দীর্ঘ সাত-আট বছর ধরে। আমি তাকে শুধু একবার দেখলেও সে আমাকে একেবারেই দেখেনি। সেই দেখাটাও খুব ক্ষণিক সময়ের জন্য। তাই অনুভূতির পারদটা একেবারে সপ্তমে। এ দেখা আমাদের সামনাসামনি প্রথম সাক্ষাৎ।

গত রাতে বোকার মতো একটা কাজ করে ফেলেছি। তার প্রিয় ফুল জারবেলা, এখন বাসার এদিকে ফুলের দোকান একেবারেই নেই। আর আমি গাধার মতো তাকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, আমার বাসার কাছাকাছি কোনো ফুলের দোকান পাওয়া যাবে কি না! সে তো রেগেমেগে আগুন। আমি আর টুঁ শব্দ করার সাহস পাইনি। ভেবে নিলাম, এই ব্যাপারটা আমার নিজেকেই সমাধান করতে হবে। নিজেকে দুষছি—কী বেরসিক আর নিরামিষ মানুষ আমি! এসব সারপ্রাইজ থাকার কথা, কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করে! নিজের ওপর অভিসম্পাত দিতে দিতে ভরসার স্থল গুগল ম্যাপে কাছাকাছি ফুলের দোকান খুঁজে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরে চলে গেলাম ফুলের দোকানে। সুন্দর একগুচ্ছ জারবেলা ফুল হাতে নিয়ে রওনা দিলাম তার কাছে যাওয়ার জন্য, তাকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য। সে কি মানবী নাকি দেবী! কল্পনায় যার ছবি এঁকেছি, সে কি বাস্তবে তার চেয়ে বেশি সুন্দর! এমন হাজারো ভাবনা মাথায় নিয়ে তার বাসার গলির মুখে পৌঁছে গেলাম। মুঠোফোন হাতে নিয়ে আমার অবস্থানের কথা তাকে জানালাম।

ক্ষণিক সময় পর সে এল। ধীরলয়ে, মুচকি হেসে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার হৃৎপিণ্ডের সব রক্তপ্রবাহ যেন এক মুহূর্তে হাজার গুণ বেড়ে গেল। মস্তিষ্ক যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। আমি বোকার মতো ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শব্দহীন হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর দুহাত জোড় করে নমস্কার দিচ্ছি, ঠিক যেমন ভিডিও কলে বলতাম। তার সে কী হাসি! তার চোখজুড়ে দুষ্টুমির ছাপ। যে চোখের প্রেমে পড়েছিলাম আমি, আমার হৃদয়ে ফুটেছিল পলাশ, তাকে এত দিন পরে দেখে সেই চোখেই হলো সর্বনাশ। অবাক নয়নে কিছুক্ষণ রইলাম চেয়ে, এরপর নিস্তব্ধতা। মানুষভর্তি রাস্তায় যেন আমরা দুজন দাঁড়িয়ে রইলাম একাকী! বাকিরা অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে আমার অবস্থা দেখে সহাস্যে বলে উঠল, ‘গাড়ি নেবেন না! নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব!’ তারপর কী যে জিজ্ঞেস করছিলাম আর কী যে বলছিলাম—পুরো মাথাটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ ত্রিচক্রযানযোগে রওনা দিলাম আমাদের পর্যটনস্থলে। সে আমার আর তার মাঝখানে ব্যাগ দিয়ে প্রাচীর তৈরি করল, আর এক পাশে তাকিয়ে হেসে চলেছে। আমার দিকে চোখে চোখ রাখতেই পারছিল না।

পথ যতই এগোচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, সে আমার কত দিনের আরাধ্য, কত বর্ষের সাধনার ফল। ‘হৈমন্তী’ গল্পের নায়কের সেই বিখ্যাত বচন ‘আমি পাইলাম, ইহারে পাইলাম’ বারবার মাথায় আসছিল। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কথা বলছে আমার চোখ এড়িয়ে, সে এক রহস্যময়ী, বিচিত্রা। সে আমাকে দেয়নি অবসর, ভালোবাসার অনলে পুড়ছি রাত যখন চান্দিপসর। আমার অবাধ্য হাত বারবার তার হাত ধরতে চায়, কিন্তু সে দূরেই থাকছে, কাছে যেন আসবে না শপথ করেছে। আমিও লাজুক দৃষ্টিতে দুষ্টুমিষ্টি চোখে তার দিকে তাকাই আর মাঝেমধ্যেই কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি।

তার আর আমার মাঝখানের ব্যাগটার দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। সফল আমাকে হতেই হবে। ‘দীর্ঘ বর্ষ ধরি সাধন করিলাম তারই জন্য, সে আমায় করিবে না পর, হবে শুধু আমারই ঘর’।

সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া