রমজান ও আমাদের ছেলেবেলা

রোজা
কিন্তু এই মানুষটিই রমজান এলে ভোরের নদীর মতো একেবারে শান্ত হয়ে যেতেন, নিচু গলায় কথা বলতেন। রমজানের যে আলাদা শান্তি আছে, তা প্রথম আব্বার পরিবর্তন দেখেই আবিষ্কার করেছিলাম।

আমরা সুখের স্মৃতিগুলোকে হয় খুব যত্নে বুকপকেটে পুরে রাখি, নয়তো নতুন কাপড়ের মতো আলতো ভাঁজে আলমারিতে তুলে রাখি। স্মৃতির পালে হাওয়া লাগলে ভাঁজ খুলে দেখি, রোদে মেলে দিই, গন্ধ শুঁকি, পুরোনো স্মৃতির গন্ধ। রমজান এলেই স্মৃতির গাঙে নৌকা বেয়ে উজানে ঠেলে যাই। আবেগে আপ্লুত হই, একের পর এক ওলটাতে থাকি স্মৃতিবন্দী পাতা।

ছেলেবেলায় শবে বরাতের পর থেকেই রমজানকে স্বাগত জানানোর জন্য আঙুলের গিঁট গুনে, দিন ফুরানোর হিসাবে লেগে যেতাম। তখন রমজান মানেই ছিল হেসেখেলে বেড়ানোর দিন, রমজানের রাত মানেই ছিল পড়াশোনাবিহীন। সেই সময় নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে রোজা শুরু হওয়ার কারণে পড়াশোনার খুব একটা চাপ থাকত না। রমজানের আগেই বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত। পুরো রমজানসহ একেবারে ঈদের ছুটি পেয়ে যেতাম স্কুল থেকে। সেই সময়টা ঈদের টানটান উত্তেজনা নিয়ে পড়ালেখা শিকেয় তুলে কাটিয়ে দিতাম পুরো মাস।

এই নির্ভাবনায় থাকার মূল কারণ ছিলেন আব্বা। আব্বা ভয়াবহ রকমের রাগী মানুষ ছিলেন। তাঁর বিকট চিৎকারে চিল-কাক উড়ে যেত অন্য পাড়ায়। আমরা সব সময় তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতাম। তিনি লেখাপড়ার বিষয়ে এত কড়া ছিলেন—সপ্তাহে একদিনও টেলিভিশন দেখার অনুমতি পেতাম না। কিন্তু এই মানুষটিই রমজান এলে ভোরের নদীর মতো একেবারে শান্ত হয়ে যেতেন, নিচু গলায় কথা বলতেন। রমজানের যে আলাদা শান্তি আছে, তা প্রথম আব্বার পরিবর্তন দেখেই আবিষ্কার করেছিলাম।

ভোররাতে মসজিদে রান্নার জন্য সাইরেন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চা-কাচ্চারা মা-কাকিদের সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতাম। তারপর ব্রাশ করতে করতে এবাড়ি–ওবাড়ি ঘুরে বেড়াতাম, সমবয়সীদের ডেকে তুলতাম। বিশেষ করে আমি, ফুফু আর আমার ছোট ভাই একসঙ্গে এই কাজ করতাম। ফুফু আমার ছেলেবেলার সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে—তাকে বাদ দিয়ে ছেলেবেলার কোনো স্মৃতিই আমি চারণ করতে পারি না। তো যা বলছিলাম, এবাড়ি–ওবাড়ি সবাইকে জ্বালিয়ে এসে সাহ্‌রি শেষ করে প্রাতর্ভ্রমণে বের হতাম।

শীতের সময় রোজা হওয়ার কারণে ভোরবেলায় চারদিকে ঘন কুয়াশা পড়ে একেবারে সাদা হয়ে থাকত। এতটাই ঘন হয়ে কুয়াশা পড়ে থাকত—কয়েক হাত দূরে কিছুই দেখা যেত না। সেই কুয়াশার বুক চিরে লুকোচুরি খেলতাম। নিজেদের তখন হ্যারি পটার মনে হতো। খুব সহজেই একটু জায়গার মধ্যেই নিজেদের ডুবিয়ে দিতে পারতাম জাদুর ধোঁয়ার মতো দেখতে কুয়াশার মধ্যে।

চারদিকে আলো ফুটে উঠলে বাড়ি ফিরে এসে হিসাবে বসে যেতাম ইফতারের সময় নিয়ে। অবশ্য ইফতারের আগেই কত কিছু যে মনের বেখেয়ালে পেটে চলে যেত তার হিসাব নেই। সব সময় যে বেখেয়ালে এটা-সেটা খেয়ে ফেলতাম তা কিন্তু না। কখনো কখনো মনের খেয়ালেই খেতাম। সারা দিন যা যা খেতে ইচ্ছা করত; যেমন গাবের বিচি, তালের আঁটি, বরই, ছোলা সেদ্ধ, পেঁয়াজু, খেজুর, বেগুনি—এসব কিছু নির্দিষ্ট একটা জায়গায় রেখে দিতাম। ইফতারের পর সেগুলো বের করে গরুর মতো জাবর কাটতে থাকতাম।

এসব অনুভূতি আসলে লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। জোহরের নামাজ ও মক্তব পড়ে এসে রান্নাঘর আর খাবারের টেবিলের পাশে ঘুরে ঘুরে খাবারের ঘ্রাণ নিতাম। আমি রান্নার ঘ্রাণে তুষ্ট থাকলেও ছোট ভাই শুধু ঘ্রাণে তুষ্ট থাকত না। সে টেবিলে থাকা প্রতিটি বাটির ঢাকনা খুলে টপাটপ এটা-সেটা মুখে পুরে নিত। এমনভাবে মুখে দিত, যাতে কেউ দেখতে না পায়।

সময় কাটানোর উদ্দেশে বিকেলের দিকে ফুফু, আমি আর আমার ভাই স্থানীয় বাজারে যেতাম ইফতারির দোকান ঘুরে দেখার জন্য। আশপাশে সাজিয়ে রাখা বাহারি ইফতারির রং ও ঘ্রাণ জিবে জল এনে দিত। ঢোঁক গিলতে গিলতে বাসায় এসে সবার সঙ্গে ইফতারে বসে যেতাম। যথাসময়ে ইফতার শেষে মাগরিবের নামাজ, রেডিওতে নাতে রাসুল শেষ হয়ে দুর্বার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যেত; এরপরও আমরা এটা-সেটা খেতেই থাকতাম।

গলা পর্যন্ত ইফতারি খেয়ে আমি আর আমার ছোট ভাই ঢুলতে ঢুলতে মসজিদে তারাবিহ পড়তে যেতাম। আসলে ঠিক তারাবিহ পড়তে না; পাড়ার ছেলেপুলেরা একত্র হয়ে দুষ্টুমি করতে যেতাম। মসজিদে মুরব্বিরা প্রথম দিকে দাঁড়াতেন আর আমরা বাচ্চারা একেবারে পেছনের দিকে। নামাজের মধ্যে ইমাম যখন তিলাওয়াত শুরু করতেন, আমরা তখন পেছনের লাইট বন্ধ করে মেতে উঠতাম চড়, লাথি, কিল-ঘুষি আর লাফালাফির আনন্দে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের যখন বকা দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া হতো, তখন আমরা স্থানীয় স্কুল মাঠে গিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা দিতাম আর গলা ছেড়ে নিজেদের তাৎক্ষণিক সুর করা গান গাইতাম। কী ভাষায় যে গাইতাম, তা নিজেরাও জানতাম না।

এই একই রুটিনে ধীরে ধীরে রমজান শেষ হয়ে যেত, সেই সঙ্গে শেষ হতো আমাদের আনন্দের দিন। আসলে সারা বছর এত কড়া শাসনের মধ্যে থাকতাম—সপ্তাহে এক দিন টেলিভিশন দেখা তো দূরে থাক, খেলাধুলার সময়ও পেতাম না। ভোরভেলা উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে মক্তবে যেতাম তারপর; কোচিং, স্কুল, প্রাইভেট, হোমওয়ার্ক এসবের মধ্যে সকাল থেকে ঘুমানোর আগপর্যন্ত সময় ব্যয় হয়ে যেত। রমজান না থাকলে হয়তো আমরা জানতেও পারতাম না—কুয়াশা জড়ানো ভোর কত সুন্দর হয়। কত সুন্দর হয় বিকেলের রক্তিম আকাশ, কত সুন্দর হয় খোলা মাঠের চাঁদনি রাত।

বনশ্রী, ঢাকা