দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা

বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বন্ধুসভার বন্ধুরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকেন। ছবিটি ২০২২ সালে কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত ঝুনকার চরে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার ত্রাণ বিতরণেরছবি: বন্ধুসভা

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত, যার কারণে সারা বছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, ভূমিধস, ভূমিকম্পসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেখা মেলে। গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্স–২০২০ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯৮ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের ভূমিধস, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধস ও ২০২২ সালে সিলেটে বন্যা। এসব দুর্যোগের অন্যতম কারণ ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, আবহাওয়ার অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী-ভরাট, বন উজার ও বৃক্ষনিধন উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও খরায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ১০০ বছরে অন্তত ৫৮টি বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। ৫০ বছরে হয়েছে ৫৩টি বন্যা, যার মধ্যে ছয়টি মহাপ্লাবন; ১৩৫ বছরে সংঘটিত হয়েছে ২৯টির বেশি বড় বড় ভূমিকম্প। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছোট–বড় মিলিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে ১৬৭টি। এর মধ্যে ১৫টি অত্যন্ত ভয়াবহ।

এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যা ছয় থেকে আট লাখ এবং ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত দশকগুলোর মধ্যে ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৪, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের বন্যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। একইভাবে ১৯৮২, ১৯৮৯ ও ১৯৯৪ সালের খরায় দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তিনটি বিষয় সরাসরি জড়িত। প্রথমটি, দুর্যোগ-পূর্ববর্তী প্রস্তুতি। দ্বিতীয়টি, দুর্যোগ চলাকালে কর্মকাণ্ড এবং তৃতীয়টি, দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। এ তিন পর্যায়েই সরকারের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকা বিস্তর। যেকোনো এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান ও সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত স্থানীয় পর্যায়ের অংশীদারেরা। ওই সব এলাকায় যখন দুর্যোগ আঘাত হানে, তখন তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকে। যেহেতু স্থানীয় নেতৃত্ব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সব পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতৃত্ব দেয়, সুতরাং তাদের মতামত ও পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।

দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ব্যবহার উপযোগী মডেল তৈরি করেছে। দুটি প্রধান উপাদানের ওপর ভিত্তি করে মডেলটি নির্মিত। প্রথমত, ঝুঁকি হ্রাস; যার মধ্যে রয়েছে ঝুঁকি পরিবেশ নির্ধারণ করা ও এর ভিত্তিতে ঝুঁকি পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় নেতৃত্বের অংশীদারেরা এ দুই বিষয় সামনে রেখে দুর্যোগকালে সহায়তা দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা দুর্যোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা গ্রহণ করে তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ঝুঁকি বিবেচনা করে আপদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্যোগ প্রতিরোধ, প্রশমন, অভিযোজনসহ যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা করে থাকেন।

বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা তুলে দিচ্ছেন সিলেট বন্ধুসভার বন্ধুরা
ফাইল ছবি: বন্ধুসভা

দ্বিতীয়ত হলো জরুরি অবস্থায় সাড়া দেওয়া। যেখানে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে স্বেচ্ছাসেবীসহ স্থানীয় নেতাদের। সতর্কসংকেত, পূর্বসতর্কতা, স্থানান্তর, অনুসন্ধান, উদ্ধার, চাহিদা ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসাসেবা সরবরাহ, পুনর্বাসনসহ নানা কর্মকাণ্ডে তাঁদের রয়েছে বিশেষ অবদান। স্বেচ্ছাসেবীরা মাইকিং, লিফলেট বিতরণসহ নানাভাবে সবাইকে এ বিষয়ে অবহিত করে থাকেন। এ ছাড়া স্থানীয় নেতারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাইকে করণীয় সম্পর্কে অবহিত করে থাকেন। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১, ১১ ও ১৩, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫), ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে ১৭ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার ১২টি প্রকল্প এবং বিভিন্ন ত্রাণ ও সামাজিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা
নিকট অতীতে যখন মহামারি করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন চরমভাবে ব্যাহত হয়। সে সময় স্বেচ্ছাসেবকেরা দায়িত্ব নিয়ে অংশ নেন নানা সামাজিক কাজে। বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে দুস্থদের পাশে দাঁড়ায়, খাদ্যসহ পৌঁছে দেয় নানা সামগ্রী। করোনায় কাজ হারানো দুস্থ-অসহায় পরিবারের আলোকবর্তিকা হয়ে জীবন বাজি রেখে কাজ করে গেছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। এমনকি করোনায় আক্রান্ত মৃত মানুষের দাফন সম্পন্ন করার মতো মানবিক কাজে তাঁরা ছিলেন অগ্রগামী। করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রমেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, যেখানে মানবকল্যাণই একমাত্র মুখ্য বিষয়।

দুর্যোগের সময় অনেকেই জীবন বাঁচাতে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে অনেকের জানা নেই। প্রান্তিক মানুষকে সহজভাবে তাঁদের মতো করে জলবায়ু পরিবর্তন ও করণীয় কাজ সম্পর্কে ধারণা দিতেই গ্রাম ও হাওরের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করে চলেছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী তরুণ-তরুণী। প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে অন্যান্য জায়গার তুলনায় খাদ্যঘাটতি থাকে বেশি। নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা বেশি পরিমাণে ব্যাহত হয়। এসব সমস্যার সমাধানেও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করে থাকেন। বন্যায় যখন এলাকার পর এলাকা প্লাবিত, মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা তখন ত্রাণ হাতে পৌঁছে যান মানুষের দুয়ারে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবকেরা হয়ে উঠতে পারেন সরকারের কার্যকরী সহযোগী হিসেবে। এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও কাজের সঠিক মূল্যায়ন।

স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা নানা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবিলার উপযোগী উপকরণ ও সরঞ্জাম সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এসব ব্যবহারের জন্যও যথাযথ নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। স্বেচ্ছাসেবকদের গৃহীত প্রতিটি উদ্যোগে অনুপ্রেরণা দেওয়া তাঁদের আরও উৎসাহী করে তোলে। দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে সরকারের সঙ্গে স্থানীয় নেতৃত্ব, স্বেচ্ছাসেবক ও অন্য অংশীদারদের সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে অধিকাংশ অভিভাবক সহশিক্ষা কার্যক্রমকে সমর্থন করেন না পড়ালেখার ক্ষতির আশঙ্কায়। এমন অহেতুক ধারণা ভাঙা জরুরি। প্রকৃতিসৃষ্ট এসব সংকটে তরুণ-তরুণীরা পালন করতে পারেন কার্যকরী ভূমিকা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে সামাজিক উন্নয়নকাজে বিশেষ অবদান রাখার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়ে থাকে। এতে তাঁরা আরও উৎসাহী হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বেচ্ছাসেবকদের মূল্যায়ন বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। একদিকে যেমন ভালো কাজের স্বীকৃতি মিলবে, অপর দিকে অন্যরাও এতে উৎসাহী হবেন। স্বেচ্ছাসেবা কেবল ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছার বিষয় নয়, বরং এটি একটি দায়িত্ব। দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। ভবিষ্যতে নানা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাসেবকেরা পালন করতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এটি যেমন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ, পাশাপাশি দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সঠিক মাধ্যম।

দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ