‘পরিবারে আমরা প্রতিটি “না”–কে “হ্যাঁ”–তে রূপান্তর করতাম

ব্রাজিল নারী ফুটবলের কিংবদন্তি মার্তা। নারী ফুটবল ইতিহাসেরও অন্যতম কিংবদন্তি তিনি। ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন রেকর্ড ছয়বার। খেলেছেন ছয়টি বিশ্বকাপ। চলমান প্যারিস অলিম্পিকে ব্রাজিলকে সিলভার মেডেল এনে দেওয়াতেও তাঁর অবদান অনেক। গত বছর দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন–এ দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হলো।

বল নিয়ে ছুটছেন মার্তারয়টার্স

যা কিছু আমি করি, যত কিছু করেছি, জীবনে যত সফলতা অর্জন করেছি; এসবের কৃতিত্ব আমার মায়ের।

ব্রাজিলের ছোট্ট রাজ্য আলাগোসের সারতাওতে বেড়ে ওঠা। প্রতিদিন সকালে জেগে উঠতাম এবং খেলার জন্য ফুটবল খুঁজতাম। কেবল এটাই করতে চাইতাম। দ্রুত পোশাক পরে রাস্তায় চলে যেতাম। কোথায় ফুটবল খেলা হচ্ছে, খুঁজে বের করতাম। চারদিকে সব ছেলে ছিল।
কোনো মেয়ে নেই। একজনও না। কেবল ছেলেরা এবং আমি। নিজেকে তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতাম।

শহরে অন্য কোনো মেয়ের সাহস ছিল না। তারা কখনো ফুটবল দলে খেলার কথা ভাবত না। কিন্তু আমি? ফুটবলকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। তাই যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও আমি খেলতে যেতাম। মানুষ কী বলল, পাত্তা দিতাম না।
ছেলেরা আজেবাজে কথা বললে তাদের ইগনোর করতাম এবং খেলা চালিয়ে যেতাম। তারপর যখন খেলা শেষে বাড়িতে ফিরতাম, আমার আত্মশক্তির মূল উৎস ছিল আমার মা।

ছয়বার ফিফা বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের স্বীকৃতি পেয়েছেন মার্তা
ছবি : ফিফা

প্রতিদিন খুব ভোরে মা কাজে চলে যেতেন। পরিবার এবং আমাদের চার ভাইবোনকে সহায়তা করার জন্য তিনি রাত পর্যন্ত কাজ করতেন। তারপর যখন সন্ধ্যা সাতটা বা রাত আটটায় বাড়ি ফিরে আসতেন, তখন প্রতিবেশীদের বাজে কথা শুনতে হতো।
এই মেয়েটা সারা দিন ছেলেদের সঙ্গে কী করে? কেন আপনি মেয়েকে ছেলেদের খেলা খেলতে দেন? সে কী প্রমাণ করতে চায়?

অন্যদিকে আমার মা। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে ভালো রাখুক। তিনি সমালোচনাকারী প্রতিবেশীদের দিকে তাকাতেন এবং একটুও পাত্তা দিতেন না। তিনি কখনোই আমার কাছে এসে বলেননি যে খেলা বন্ধ করো। তিনি আমাকে কেবল খেলতে দিতেন। আমার মা খুবই ধার্মিক এবং ক্যাথলিক। তিনি সব সময় বলতেন, ‘যদি মার্তা ফুটবলের জন্য হয়ে থাকে, সৃষ্টিকর্তা তাকে পথ দেখাবে। সুতরাং তাকে খেলতে দাও।’

প্রতিদিন রাতে মা বাসায় ফেরার পর আমাদের ভাইবোনদের জন্য ডিনার তৈরি করতেন। নিশ্চিত করতেন, চাহিদা অনুযায়ী যেন আমরা সব পাই। পরের দিন সকালে আবার তৈরি হয়ে খেলতে চলে যেতাম। এটি ছিল আমার জন্য অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক। মা কীভাবে জীবনকে উপভোগ করতেন, পরিবারকে সহায়তা করতেন এবং আমাকে ফুটবল খেলতে দিতেন; যাতে আমি খুশি হই। এসব আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাস দিত।

নারী বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ১৭ গোল করেছেন মার্তা
ছবি : ফিফা

এটি ছিল আমার জন্য তাঁর উপহার। পরিবারে আমরা প্রতিটি ‘না’–কে ‘হ্যাঁ’–তে রূপান্তর করতাম। যত দিনই লাগুক না কেন, ব্যাপার ছিল না। আমি যা ভালোবাসি, তিনি তাই করতে দিতেন। অন্য মানুষ কী বলল, তাতে কিছু যায়-আসে না। আজ আমি যেখানে, সব মায়ের জন্য।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, আমরা যারা নারী ফুটবলকে ভালোবাসি; ভালো কাঠামোর জন্য লড়াই করতাম। এখন আমাদের সবকিছু আছে। আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানাতাম। এখন অনেক বিনিয়োগ আছে। তারপরও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। তবে এখনো অনেকে জানে না যে আমরা কত দূর এগিয়েছি।

যখন ছোট ছিলাম, আশপাশে এমন কোনো নারী ফুটবলার ছিল না, যাকে দেখে অনুপ্রেরণা পেতাম; কিংবা তার মতো হতে চাইতাম। রিভালদোকে (ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কিংবদন্তি) অনুসরণ করতাম। তিনি যেভাবে খেলতেন, আমি পছন্দ করতাম। পুরুষ দলের কাউকে অনুসরণ করা ছাড়া আমার কাছে কোনো বিকল্প ছিল না।

বর্তমানে আমাদের নারীদেরও অনুসরণ করার মতো ফুটবলার রয়েছে, যা আমাকে গর্বিত করে। আমি খুবই খুশি যে বিশ্বের অসংখ্য ছোট ছোট মেয়ে আমাদেরকে মাঠে ফুটবল খেলতে দেখতে পারে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। এটি আমার কাছে অনেক কিছু। ট্রফি, মেডেল কিংবা শিরোপা থেকেও এটি বেশি মূল্যবান।