একদিন এক দুপুরে রোদে জ্বলে ওঠা ঢাকায় রবিন ভাই হাঁটছিলেন। চারপাশে মানুষের ব্যস্ততা, হইচই, ক্লান্তিকর হর্নের শব্দ, তাপমাত্রা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। ঘর্মাক্ত দেহ আর তৃষ্ণার্ত হৃদয় বারবার ইশারা করছিল একটু ছায়া আর এক গ্লাস পানির জন্য। চারদিকে তাকালেন। বসার মতো একটা জায়গা পর্যন্ত নেই, শুধু মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছিল, এই মানুষের স্রোতে তিনিও হয়তো একসময় হারিয়ে যাবেন। তৃষ্ণায় ক্লান্ত হৃদয় ছটফট করছিল এক গ্লাস ঠান্ডা পানীয়ের জন্য।
ঢাকা শহরে কয়েকটা ছায়াদানকারী গাছ ছাড়া বড় গাছ খুব একটা দেখা যায় না। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি পুরোনো ধুলোমাখা গাছের নিচে কয়েকজন মানুষ আড্ডা দিচ্ছে, আর একজন শরবতওয়ালার কাছ থেকে শরবত কিনছে। সেই গাছটির অবস্থা করুণ, শুকিয়ে যাওয়া পাতা, শিকড়ের ওপর জমে থাকা ধুলোবালি; আশ্চর্যজনকভাবে নিচে দিচ্ছে প্রশান্ত ছায়া।
রবিন ভাই গিয়ে দাঁড়ালেন গাছটির নিচে। শরবতের লোভ সামলাতে না পেরে শরবতওয়ালাকে বললেন, ‘এক গ্লাস শরবত দেবেন?’
ঠান্ডা শরবতের প্রতিটা চুমুক যেন তার ক্লান্তি ভেঙে দিচ্ছিল। কিন্তু শরবত শেষ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটল অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। মনে হচ্ছিল, সেই পুরোনো গাছটা তাকে অদৃশ্য টানে নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছে। শরীর হালকা লাগছিল, চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। একসময় বুঝতে পারলেন, তিনি আর নিজের শরীরটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
তিনি ভাবছিলেন, এ কি কোনো স্বপ্ন? নাকি বিভ্রম?
কিন্তু না! এই অভিজ্ঞতা ছিল বাস্তব। হঠাৎ যেন পৃথিবী বদলে গেল। চারপাশের দৃশ্য পাল্টে গেল।
নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক অদ্ভুত গ্রামে। প্রবেশপথের পাশে কাঠের ফলকে লেখা ‘গাছগ্রাম’। নামটাই বিস্ময়ের জন্ম দিল।
গাছগ্রামের রাস্তাগুলো ঠিক ঢাকার মতো রোদে ঝলমল করছিল। কিন্তু সেই রোদে ছিল না কোনো তাপের জ্বালা, বরং ছিল একধরনের শান্তি। আশপাশে চোখ ফেরাতেই চমকে উঠলেন, গাছেরা হেঁটে বেড়াচ্ছে! কেউ কেউ কথা বলছে, কেউবা খেলছে, এমনকি কিছু গাছের বাচ্চারা মাটিতে পাতা ছিঁড়ে কাগজ বানিয়ে খেলা করছে। পুরো দৃশ্যটা অবাস্তব, অথচ কেমন যেন মায়াময়।
এমন সময় এক মধ্যবয়সী গাছ তার কাছে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল, ‘আরে রবিন ভাই! আপনি অবশেষে এসে পড়েছেন!’
এ কথা শুনে আশপাশের গাছেরা একে একে তাকাতে লাগল তার দিকে। কারও মুখে বিস্ময়, কারও মুখে আনন্দ। কয়েকটি গাছের বাচ্চা দৌড়ে দৌড়ে বলে উঠল, ‘রবিন ভাই এসে গেছে! রবিন ভাই এসেছে!’
রবিন ভাই বিস্ময়ে হতবাক। ‘এরা আমাকে কীভাবে চেনে? আমি তো কোনো দিন এখানে আসিনি। আর এরা তো...গাছ! গাছ কীভাবে কথা বলে?’
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী হচ্ছে?’
মধ্যবয়সী গাছটি বলল, ‘আপনাকে আমাদের নেতার কাছে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের আপনাকে খুব দরকার, রবিন ভাই। এই গাছগ্রাম আর পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আপনার ওপর নির্ভর করছে।’
গাছগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন বৃক্ষ চিরসবুজ রাজগাছ। তার হাজার বছরের বয়সী কাণ্ডের ওপরে বসে ছিলেন। চারপাশে নীরবতা। যখন রবিন ভাই পৌঁছালেন, তখন দূর থেকে মৃদু হাওয়ার সঙ্গে পাতার মর্মর ধ্বনি যেন তার আগমনের বার্তা ছড়িয়ে দিল গাঁয়ের প্রতিটি পাতায়। রাজগাছ বললেন, ‘তুমি আসবে আমরা জানতাম। কারণ, তুমি একজন শুভ্র হৃদয়ের অধিকারী, যে শহরের ব্যস্ততা পেরিয়ে গাছের কান্না শুনতে পায়।’
রবিন ভাই মাথা নিচু করলেন। বললেন, ‘কিন্তু আমি তো কিছুই জানি না! আমি অতি সাধারণ এক মানুষ।’
রাজগাছ চোখ বন্ধ করে বলল, ‘তুমি জানো না বলেই তুমি যোগ্য। আর অতি সাধারণ হয়ে থাকতে পারাটাই অতি অসাধারণ একটা কাজ। প্রকৃতি বেছে নেয় তাদের, যারা মন খুলে শুনতে পারে, হৃদয় মেলে ভালোবাসতে পারে আর সাধারণভাবে বাঁচতে পারে। এই পৃথিবীর গাছেরা আজ আর সহ্য করতে পারছে না। মানুষ প্রতিদিন কেটে ফেলছে আমাদের ভাইদের, ধোঁয়া দিচ্ছে নিশ্বাসে বিষ। আর আমরা শুধু দেখি। তাই এবার আমাদের একজন প্রতিনিধি দরকার, যে দুই জগতের মধ্যকার সেতু হয়ে দাঁড়াবে।’ এই বলে গাছরাজ থামলেন। চারদিক সুনসান।
চারদিক থেকে গাছেরা রবিন ভাইকে ঘিরে দাঁড়াল। ছোট গাছেরা পাতা নেড়ে বলল, ‘আপনিই পারবেন আমাদের জন্য কিছু করতে। আপনি আমাদের রবিন ভাই!’
রাজগাছ বলল, ‘তোমাকে গাছগ্রামের অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এক পাতা দেওয়া হচ্ছে। এই পাতা পৃথিবীর মাটিতে পুঁতে দিলে যেখানেই পড়বে, সেখানেই গজাবে নতুন সবুজ, নতুন প্রাণ। এই প্রাচীন পাতার মধ্যে আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের মাটি, আর তোমার ভালোবাসা, তোমার সংগ্রাম।’
রবিন ভাই কাঁপা হাতে পৃথিবীর প্রাচীন পাতাটা নিলেন। পাতাগুলোর গায়ে ছোট ছোট হরফে লেখা ছিল, ‘রবিন বাঁচাবে পৃথিবী, আবার বাঁচবে পৃথিবী, আবার বাঁচবে গাছগ্রাম’।
এক ঝলক হাওয়া এল। সবুজ আলোয় রবিন ভাইকে ঘিরে ধরল। তিনি আবার ফিরে এলেন সেই পুরোনো গাছটার নিচে, ঢাকার সেই রোদ ঝলমলে দুপুরে। কিন্তু এবার আর তিনি আগের সেই রবিন ছিলেন না। সে তার আছে অতি সাধারণ এক পাতা আবিষ্কার করল। চুপচাপ সেই পাতাটা নিয়ে সে জায়গা থেকে চলে এল।
ঢাকার বুকে শুরু হলো এক অদ্ভুত পরিবর্তন। প্রথমে পুরোনো সড়কের পাশে হঠাৎ এক রাতেই গজিয়ে উঠল কয়েকটি ছোট গাছ। এরপর স্কুলের মাঠে, বাসার ছাদে, কারখানার পাশে সবখানেই অদ্ভুতভাবে গাছ জন্মাতে লাগল। লোকজন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকল। চারদিকে শোরগোল লেগে গেল। সংবাদপত্রগুলো শোরগোল তুলল, ‘সবুজের সমুদ্র ঢাকা শহরে! কে এই বৃক্ষবীর?’
কেউ জানত না, শহরের এক কোণে, এক তরুণ রবিন ভাই, পকেটে করে নিয়ে ঘুরছেন গাছগ্রামের সেই জাদুকরী প্রাচীন পাতাটি। যেখানে যেখানে ছুঁয়ে দেন, সেখানেই গজায় প্রাণ। তিনি জানতেন, এটা শুধু গাছ লাগানোর গল্প নয়। এটা প্রতিজ্ঞার গল্প। এই পৃথিবীকে আবার সবুজ করার, শিশুদের হাসির নিচে ছায়া ফেরানোর এবং প্রকৃতিকে তার আসন ফিরিয়ে দেওয়ার গল্প।
বছরখানেকের মধ্যেই চারদিক সবুজ হয়ে গেল। সবুজ আর সবুজ। পৃথিবীর মানুষ এই সবুজ দেখতে চারদিক থেকে আসতে লাগল। রবিন ভাই এসব দেখে মুচকি হাসেন। একদিন তিনি সেই প্রাচীন গাছের নিচে যান, যেখানে রাজগাছের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। প্রাচীন পাতাটা তিনি সেখানে পুঁতে দিলেন। তার কাজ শেষ হয়েছে। এই পাতা আবার অন্য কোনো অতি সাধারণ মানুষকে খুঁজে নেবে।
একদিন ছাদে বসে একটি শিশু তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আঙ্কেল, চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। তাই না?’
রবিন ভাই মুচকি হেসে বললেন, ‘কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পাতাতে লেখা ছিল, সবুজই জীবন, সবুজই মুক্তি।’
সেই শিশুটা সব বুঝে ফেলেছে, এমন ভান করে পাতার তৈরি গাড়ি নিয়ে খেলতে লাগল।
ম্যাগাজিন সম্পাদক, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা