‘নিশি ট্রেনের ভূত’ ভৌতিক বিবরণে দুঃসময়ের আখ্যান

‘নিশি ট্রেনের ভূত’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ

‘আমার সমস্ত বাক্য আগুনে নিক্ষেপ কর শিশু… এখনো যদি ঘরে বসে নিজেকে বাঁচাই/ যদি বাধা না দিই, তত্ত্ব করি, কী হলে কার দোষে/ যদি না আটকাই, আজও না-যদি ঝাঁপিয়ে পড়িতে পারি/ আমার সমস্ত শিল্প আজ থেকে গণহত্যাকারী’ পঙ্‌ক্তিগুলো জয় গোস্বামীর ‘আজ’ শিরোনামের কবিতার। কবিতার সঙ্গে ‘নিশি ট্রেনের ভূতের’ কোনো যোগসূত্র আছে কি?

পারিজাতের জন্য ভালোবাসা, কখনো আমার মাকে উপন্যাসসহ আনিসুল হকের বেশ কিছু উপন্যাসে কালের বিবরণে জীবনের রক্তিম আলেখ্যর বর্ণনা উঠে এসেছে। যতটা না গল্পের প্রয়োজনে, তার চেয়েও বেশি সময়ের প্রয়োজনে লেখক সেসব উপাদান রচনায় যোগ করেছেন, যা সময়ের নিমিত্তে জীবনকে তাড়া করে বেড়ায়। নিশি ট্রেনের ভূত নাম থেকে উপন্যাসটি যে ভৌতিক ঘটনার চিত্রপট, তা অনুমান করতে বেগ হবে না। ভূতের গল্পে ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করার মধ্যে লেখকের অন্তর্নিহিত সাফল্যের পরিচয় মেলে। অতিপ্রাকৃত ব্যাপার, ভূতের গল্প, রহস্যময় ঘটনা নিয়ে লেখায় পরীক্ষিত শিল্পী আনিসুল হক। তাঁর ‘ভয়ংকর ভূত’ শিরোনামের গল্পগ্রন্থটি সেই দাবি রাখে। তাই সহজেই তিনি গল্পের অবয়বে ভৌতিক পরিবেশ নির্মাণ করতে পেরেছেন। কিন্তু নিশি ট্রেনের ভূত কি কেবল সাদামাটা ভূতের গল্প, নাকি ভৌতিক গল্পের অবয়বে যাপিত জীবনের দুঃসময়ের তদন্ত প্রতিবেদন?

গল্পটা ভৌতিক পরিবেশে, ভূতের মাধ্যমে কেন বলতে হলো? গল্পটাকে কেন ভূতের গল্প বলতে হচ্ছে? জয় গোস্বামীর ‘আজ’ কবিতাটির সঙ্গে নিশি ট্রেনের ভূতের যোগসূত্র কী?

উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র শিশির মোড়ল ও পাভেল। তাদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে উপন্যাস। চরিত্র দুটির মাধ্যমে লেখক কেবল গল্পই বলে যাননি। কখনো কথকের ভূমিকায় আবার কখনো চরিত্রের বর্ণনায় প্রস্ফুটিত করেছেন নানা দৃষ্টিপাত। যে কারণে সময়ের নানা কৌতূহল ও বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।

নিশি ট্রেনের ভূত ট্রেনযাত্রার গল্প। গল্প নির্মাণের প্রয়োজনে লেখককে কখনো সময়ের আগে চোখ রাখতে হয়, কখনো ফিরে তাকাতে হয় পশ্চাতে, কখনো আবার ধারণ করতে হয় সময়কে। উপন্যাসটিতে সুচারুভাবে তিনটি কাজই করেছেন লেখক। পরিবার, প্রেম-ভালোবাসা, সন্তানসন্ততি, শুভাকাঙ্ক্ষী, জীবিকা—সব ঘিরেই ব্যক্তির জীবন পরিব্যাপ্ত থাকে। এই যে পৃথিবী এত মায়াময়, তার এই তো কারণ। বিষয়গুলো উপন্যাসটিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

তা ছাড়া পাভেল যখন শিশির মোড়লকে গল্প বলতে শুরু করেন, তখন কোনো রাখঢাক রাখেননি তিনি। ছাত্রজীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে বকুল, বর্তমানে যে তার স্ত্রী। তাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বকুল তখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। বিয়েতে রাজি না সে। লেখাপড়া করবে, বড় হবে। বকুলের বাবা পাভেলের শিক্ষক। মেয়ের মতই তার মত। কিন্তু বকুলের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাঁর হার্টের অপারেশনের জন্য অনেক টাকা লাগবে। পাভেল ব্যবসা করে তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। তিনি এগিয়ে গেলেন, বকুলের বাবার চিকিৎসার সব খরচ বহন করলেন। তারপর কৃতজ্ঞতায় হোক কিংবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে হোক, বকুল বিয়েতে রাজি হয়। এই যে বাস্তবতা আর ব্যক্তিত্বের সংঘাত, অপারগতা, অসহায়ত্ব; লেখক যদিও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি, তবে জীবনের অন্তর্ঘাতমূলক দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন স্পষ্টভাবে।

বকুলের প্রতি পাভেলের সত্যিই কি ভালোবাসা ছিল, নাকি কেবল ছিল মোহ ও শারীরিক আকর্ষণ? ভালোবাসা থাকলে পরে শিরিনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে সেকি সম্পর্কে জড়াতে পারতেন? প্রশ্নটিও প্রসঙ্গান্তরে কাহিনির নিরিখে জারি রেখেছেন লেখক।

জীবনের সমাজের নানা টুকরো ছবি চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। বলা চলে টুকরো টুকরো অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোকে নিয়ে লেখক ছবি এঁকেছেন। ট্রেনে একসঙ্গে অনেক মানুষ ভ্রমণ করে থাকেন। সেখানে নানা বয়সের, নানা পেশার, শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি থাকে। তা ছাড়া আজ যে শিশু, কাল সে নেতৃত্ব দেবে পৃথিবীকে। সেই আহ্বানই যেন মনটি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। মনটির বয়স ৯। তার স্বপ্ন বড় হয়ে সে পাইলট হবে। পাইলট যদি না হয় তাহলে অ্যাস্ট্রোনাটস হবে।

ডিজিটাল ডিভাইসের প্রগ্‌লভায় সৃষ্টিশীলতা কি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারে? সেই আশঙ্কা থেকেই মনটি ট্রেনে যখন তার বাবার কাছে মোবাইল চায়, তখন চার্জ নেই বলে মোবাইলটা তিনি দেন না। পরমুহূর্তেই দেখা যায় মনটি ছবি আঁকতে শুরু করে। ছবি এঁকে তার পাশের সিটে বসা পাভেলকে দেখায়। পাভেল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তার আগের ট্রেনভ্রমণের বৃত্তান্ত বলেন শিশির মোড়লকে। কিন্তু মুহূর্তেই পাভেলের কণ্ঠ ধরে আসে, সব সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি জানান, মনটি ট্রেনে আগুনে ঝলসে মারা গেছে। গল্প সময়ের শিলালিপি থেকে দুঃসময়ে পতিত হয়। পাভেল বর্ণনা করতে শুরু করেন ট্রেনে কীভাবে আগুন লাগল, কারা আগুন দিল, কেন আগুন দিল, যারা আগুন দিল তাদের কে নির্দেশ দিলেন সবকিছু।

গল্পটা ভৌতিক পরিবেশে, ভূতের মাধ্যমে কেন বলতে হলো? গল্পটাকে কেন ভূতের গল্প বলতে হচ্ছে? জয় গোস্বামীর ‘আজ’ কবিতাটির সঙ্গে নিশি ট্রেনের ভূতের যোগসূত্র কী? ট্রেনে কেউ কেন আগুন দেবে, দিলে কী লাভ? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে পড়তে হবে নিশি ট্রেনের ভূত উপন্যাসটি।

২০২৪ সালে প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় ‘প্রাপ্তবয়স্ক ভূতের গল্প’ শিরোনামে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে বই হিসেবে বের করার আগে নামসহ প্রয়োজনীয় কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে।

একনজরে
বই: নিশি ট্রেনের ভূত
লেখক: আনিসুল হক
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম
৬৮ পৃষ্ঠা
দাম: ২৮০ টাকা।