রাজকুমারী শরৎ

শরৎকালে বাংলাদেশের সৌন্দর্যফাইল ছবি

প্রিয় পুষ্পিতা,

তোমার চিঠি পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছি। এই যুগে এসেও তুমি আমাকে চিঠি দিতে ভোলোনি, এটা আমাকে অনেক আনন্দিত করে। প্রত্যুত্তরে তুমি আমার দেশে চলমান ঋতু সম্পর্কে জানতে চেয়েছ। খুব ভালো সময়ে জানতে চেয়েছ। এখন প্রকৃতি সেজেছে নতুন রূপে।

ছয় ঋতুর এই বাংলাদেশে এখন তৃতীয় ঋতু চলছে। ঋতুর রাজকুমারী হলো শরৎকাল। নববধূর মতো নজরকাড়া তার রূপ। কোমল, স্নিগ্ধ উদারতায় ঘেরা এই ঋতু। ভাদ্র, আশ্বিন—এই দুই মাসকে বলা হয় শরতের যৌবনকাল।

এখন বাসার ছাদে বসে তোমাকে লিখছি। মাথার ওপরে পেঁজা পেঁজা উড়ন্ত সাদা মেঘ। নীলাভ আকাশে নরম তুলতুলে ভেসে যাওয়া এই মেঘ পরশ এঁকে দিচ্ছে চিঠির পাতায়। শীতল মধুর হাওয়ায় মাঝেমধ্যে কাগজ উড়ছে। শালিক, ময়না, টিয়া মালার মতো ঝাঁক বেঁধে এদিক-ওদিক যাচ্ছে। পাশের ছাতিমগাছ থেকে ভেসে আসছে শিল্পী পাখির মধুর গুঞ্জন। ছাতিম ফুলের মিষ্টি সুবাস আর পাখিদের সুর এক হয়ে মনরাঙা পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। জানো, কোমল রোদ এখন আমার অন্দরে খেলা করছে। কী দারুণ এক স্বপ্নপুরীর মতো আয়োজন ভাবো! তুমি আমার দেশের শরতের এই রূপ অবলোকনে চলে এসো এবার।

ঘরে ফিরে এলাম। বারান্দায় বসে লিখছি এখন। কী করব, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। এই সময় ক্ষণিকের জন্য হুটহাট বৃষ্টি নামে। সবখানে না, এদিকে আছে তো ওই দিকে নেই।

এখন শুভ্র ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজমান। দূর্বাঘাসের ওপর শিশিরভেজা শিউলি আলপনার মতো বিছিয়ে থাকে। নরম ঘাসে পা দিয়ে শিউলি কুড়িয়ে আঁচল ভরার যে কী স্বর্গসুখ! আমি এই ফুলের মালা গাঁথতে খুব ভালোবাসি। সাদা আর জাফরান রং মাখানো শিউলির ভারি মিষ্টি গন্ধ। শরতে আরও নানা ফুলের বাহার দেখা যায়। শালুক, পদ্ম, জুঁই, কামিনি, কেয়া, রাধাচূড়াসহ অনেক।

গতকাল শরৎরাঙা সকাল দেখতে বের হয়েছিলাম। আমি আর আমার কাজিন নীহা। হালকা শীতল আবহাওয়ায় ছিল মাতাল হাওয়া। গিয়েছিলাম মাঠের দিকে। কচি ধানের ডগায় শিশিরবিন্দু চিকচিক করছিল। কচি ধানের ডগাগুলো মৃদু রোদে কিশোরের মতো উল্লাসে ভাসছিল যেন। দীর্ঘ বৃষ্টির পর সবে শুকাতে শুরু করেছে মাঠঘাট। বৃষ্টি যেন সব ধুয়েমুছে প্রকৃতিকে করেছে আরও নির্মল। মাঠের চারপাশে সবুজের বেষ্টনী। তার প্রান্ত ঘেঁষে দূরের গ্রামগুলো ঠিক ছবির মতো দেখাচ্ছিল। এরই মধ্যে কৃষকেরা চলে এসেছেন ফসল দেখতে। মাঠজুড়ে ধানের দিকে চেয়ে তৃপ্তির হাসি তাঁদের মুখে। ঠিক যেন মাতৃত্বের স্বাদ। মাঠের প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী অলকন্দ। ওই ধারের বালুর চরজুড়ে কাশফুলের বাগান। কাশফুল হলো শরৎ রানির আরেক মোহনীয় সৌন্দর্য। নদীতে বহমান মৃদৃ হাওয়ায় দুলছে এলোকেশী সাদা কাশফুল। এই সৌন্দর্য স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা মুশকিল। এখন ধানের ডগায় উপচে পড়েছে রোদ। একটু পরই কাঠফাটা রোদ আসবে। তাই বাড়ির দিকে উঠে পড়ি। পথিমধ্যে রহিম চাচার পুকুরে চোখ আটকে যায়। স্বচ্ছ পানির বুকে ছোট্ট শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে বেড়াচ্ছিল শাপলা। কত কত শাপলা ডানা খুলে বসেছিল। মনে হচ্ছিল রোদে গা এলিয়ে দিয়েছে। পানিতে ডুবো ডুবো শাপলা পাতাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল বিছানা পাতা হয়েছে। ঋতুর রাজকন্যা শরৎ রানির কিচ্ছুর অভাব নেই। সত্যিকারের রাজকুমারী যেন।

তোমাকে লিখতে লিখতে কবে যে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠেছে খেয়ালই করিনি। গোধূলির লাল আভা ছড়াচ্ছে আকাশজুড়ে। পাখির কিচিরমিচির থেমে গেছে। ঘরে ফিরেছে সব পাখি; কিন্তু ঘরে ফিরতে চায় না আমার বারোয়ারি মন। বাতি নিয়ে ছাদে গিয়ে বাকিটুকু লিখব কেমন?

চাঁদের আলো ফুটতে শুরু করেছে এখন। মনমাতানো হাওয়ায় উড়ছে কামিনী আর মেহেদি ফুলের সুঘ্রাণ। সঙ্গে যোগ দিয়েছে সুবাসিনী বেলি। কী যে ভালো লাগছে! দূর বাঁশবনে ডাহুক পাখি ক্ষণে ক্ষণে ডাকছে। জোনাকির সোনালি আলো মুক্তার মতো জ্বলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, রূপকথার সাপের মণি। মোহিত এই জ্যোৎস্নার কাছে হার মেনেছে ল্যাম্পপোস্টের আলো।
এমন রূপে মুগ্ধ হয়েছেন কবিরাও বারবার। রূপের বর্ণনা করেছেন নানা ছন্দে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের অনুপম সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লিখেছেন—
‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শিউলিমালা,
নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।
এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,
   এসো নির্মল পথে।’

কাজী নজরুল ইসলাম আনমনে গেয়েছেন—
‘এসো শারদ প্রাতের পথিক
এসো শিউলি-বিছানো পথে,
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে
এসো অরুণ-কিরণ-রথে।’

অনেক লিখেছি। আজ আর নয়। তুমি এমন রূপের সাক্ষী হতে চলে আসো আমার দেশে। খুব খুশি হবো। বেশি দেরি করা যাবে না কিন্তু। শরৎ শেষে হেমন্ত আসবে উৎসবমুখর পদধ্বনিতে।

কলমে,
তোমার প্রিয় স্বপ্নবিলাসী

বন্ধু, কক্সবাজার বন্ধুসভা