আমাদের মায়েরা
পড়াশোনা বন্ধ করেননি
গত রোববার ছিল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মায়ের সঙ্গে তাঁদের স্মৃতি ও ভালো লাগার ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য লেখা পাঠিয়েছেন বন্ধুসভার বন্ধু ও পাঠকেরা। বাছাইকৃত লেখা নিয়ে আজকের আয়োজন।
আমার বয়স তখন দশ। পরিবার ছেড়ে অনেক দূরে সিলেটের এক হেফজ মাদ্রাসায় ভর্তি হই। প্রতিদিন বিকেলে মুঠোফোনের দোকানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকি মা-বাবার সঙ্গে একবার কথা বলব বলে। কিন্তু সিরিয়াল আসতে আসতে আধা ঘণ্টা লেগে যায়। তখন কাউকে কলে পাই না।
সবাই কথা বলে হাসিমুখে ঘরে যায়, আর আমি একবুক বিষণ্নতা আর হাহাকার নিয়ে ঘরে ঢুকি।
একবার টানা তিন-চার দিন এমন ঘটে। নিজেকে আর বোঝাতে পারছিলাম না। কান্না করতে করতে সুরমা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়াই; যেই ঝাঁপ দেব, সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসার বাবুর্চি ধরে ফেলে এবং প্রিন্সিপালকে নালিশ দেয়। আমাকে একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে মাকে খবর দেওয়া হয়। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেন। তবে প্রতিষ্ঠান আমাকে রাখেনি।
কয়েক বছর পর বাবা অসুস্থ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। মা নিরুপায় হয়ে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। বেতন পেতেন আট হাজার টাকা। এই বেতনে তিন ভাইবোন পড়াশোনা করছি। একজন এসএসসি আর দুজন হাইস্কুলে। সংসারের খরচ, বাসাভাড়া, পড়ালেখার খরচ, পোশাক—মা হিমশিম খাচ্ছিলেন। টাকা সঞ্চয় করার জন্য তিনি এর পর থেকে ভোর ছয়টায় বের হয়ে দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কাজে যেতেন। অফিসে যে নাশতা দিত, সেটা তিনি না নিয়ে সমপরিমাণ টাকা বেতনের সঙ্গে যোগ করতেন। অফিস থেকে ফিরে ঘরের কাজ, রান্নাও করতেন মা।
এত অভাবের মধ্যেও কখনো আমাদের অভাব বোধ করতে দেননি মা। অফিসের কোনো অনুষ্ঠানে ভালো কিছু দিলে আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। মায়ের নাকি খেতে কষ্ট হয়। খেতে গেলেই মনে হয়, ছেলেমেয়েরা তো খাচ্ছে না।
কয়েক বছর পরই বাবা মারা যান। মা ওয়ান ম্যান আর্মির মতো আমাদের আগলে রাখেন। অনেকেই বলেছিল, ‘ছেলে দুটোকে কাজে দিয়ে দেন, টাকা আসবে।’ কিন্তু মা আমাদের পড়াশোনা বন্ধ করেননি। এখনো স্নাতক শেষ হতে দেড় বছর বাকি। টিউশন করে নিজের খরচ চালাতে পারলেও এখনো মায়ের জন্য কিছু করা হয়নি। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা, মাকে সুস্থ রাখুন। আমার সব অর্জন হবে কেবল মায়ের জন্য।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা