বৃষ্টিস্নাত দিনে নুহাশপল্লীতে

নুহাশপল্লী ঘুরে...ফাইল ছবি

‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদে এল বান
যদি ডেকে বলি,
এসো হাত ধর চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি’

গাড়িতে বাজছিল হাবিব ওয়াহিদের গাওয়া অসাধারণ গানটি। আমাদের গন্তব্য গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নুহাশপল্লী। যাত্রার সঙ্গী স্ত্রী আফরোজা এনাম ও কন্যা বর্ণ। গাড়ি ছুটে চলছে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। আকাশে জলীয় বাষ্পগুলো উড়ছে মেঘের ভেলায় চড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল। গাড়ির স্বচ্ছ কাচের ওপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে।
মাঝেমধ্যে মেঠোপথে কাদামিশ্রিত পানিতে গাড়ির চাকা আটকে যাচ্ছিল। রাস্তার পাশে শালবন, গজার, সেগুনসহ নানা গাছগাছালি। গাড়ি এসে থামল পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীর মূল ফটকের সামনে। হোতাপাড়া বাজার থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পেরোলে নুহাশপল্লী। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। নুহাশপল্লীতে প্রবেশ করতে ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ঢোকার পরই চোখে পড়ে মাঠজুড়ে দূর্বাঘাসের চাদর। যেন প্রকৃতির বিছিয়ে দেওয়া সবুজ গালিচা।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯৭ সালে ৪০ বিঘা জমির ওপর এটি গড়ে তোলেন। নুহাশপল্লীতে লেখক তিনটি বাংলো করেছেন। ছোট পাকা বাংলোটির পাশে আপেলগাছ। তার একটু সামনে কাঠের নকশা করা বৃষ্টিবিলাস। এটির ভেতর শুটিংয়ের সরঞ্জামসহ আরও কত কী। কিছুটা দূরে ভূতবিলাস বাংলো। ছোট একটি সুইমিংপুল নির্মাণ করেছেন। লেখক মাঝেমধ্যে পুলে নেমে গলাসমান পানিতে বসে থাকতেন, কখনো কফি-চা পান করতেন। আড্ডা দিতেন প্রিয়জনদের সঙ্গে। পাথরের ফলকে খোদাই করে লেখা, ‘রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান: আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি’। একটু দূরে বড় এক দৈত্য দানবের মূর্তি হাত বের করে দিয়ে হাঁ করে বসে আছে। অপর পাশে পদ্মপুকুরে মৎস্যকন্যার মূর্তি দেখলে মনে হবে যেন দিঘিতে হেঁটে হেঁটে পদ্মফুল তুলতে ব্যস্ত। পাশে দাবার ঘুঁটির প্রতিকৃতি, টি হাউস, নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। নুহাশপল্লীর একপাশে চোখে পড়বে শুভ্র বর্ণের হুমায়ূন আহমেদের আবক্ষ মূর্তি, লেখককে কোনো এক জন্মদিনে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া রয়েছে হরেক রকমের নাম না–জানা নয়নাভিরাম বৃক্ষ।

প্রায় ২৫০ প্রজাতির দুর্লভ ঔষধি গাছ, ফলদ, বনজ, ভেষজসহ বাহারি বিদেশি ফুলের গাছ রয়েছে। লেখক বিদেশ থেকে এনে নিজ হাতে এগুলো লাগিয়েছেন। বাংলোর পেছনে বিদেশি খেজুরগাছও চোখে পড়বে। একটু সামনে গেলে চা–বাগান। মাঠের চারদিকে হরেক রকমের বনজ ও ফলদ গাছ। এক পাশে জীবন্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি দেবী, তার নিচে ছোট্ট শিশু। তার এক পাশে কুমারী দেবী। অন্য পাশে দোলনা। ছোট ছোট কিছু মাটির কুটিরও চোখে পড়বে। একটু সামনে গেলে দেখা মিলবে আমগাছের ওপর টিনের কুঁড়েঘর। লেখক মাঝেমধ্যে কুঁড়েঘরে বসে বই পড়তেন। মাঠের ঠিক পেছনে লীলাবতী দিঘি। মাঠের মাঝখানে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো নামাজের স্থান। অন্য পাশে লিচুবাগান। সেখানেই চিরতরে শুয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। দিঘিপাড়ে কাঠের সাঁকো। পক্ষীরাজ নৌকা, পাথরে খোদাই করে লেখা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’। লাইন দুটি পড়ে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল। সত্যি আমি যেন জীবন্ত হুমায়ূন আহমেদকে অনুভব করছি। মনে হচ্ছিল এই তো লেখক মোড়ায় বসে আছেন, দোলনায় চড়ছেন, কাঠের পিঁড়িতে বসে গল্প লিখছেন। দিঘির পানিতে বড়শি নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। জোছনারাতে গানের আসর বসিয়েছেন। কেউ একজন গাইছেন, ‘ওগো দয়ার সাগর ওগো দয়াময়, চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।’

একটু পরে টের পেলাম আমি প্রিয় লেখকের বন্দনায় মগ্ন হয়ে তন্দ্রাবিলাস করছি। তন্দ্রা কেটে গেলে দেখি, আমি আর আফরোজা বৃষ্টিতে ভিজছি, দুজনের মাঝখানে নেচে নেচে বৃষ্টি উপভোগ করছে বর্ণ।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা