বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য অভিবাদন

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। আজকের দিনে আমি আমার প্রয়াত শিক্ষক পিতা ও শিক্ষাগুরু মহোদয়দের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। পিতা-মাতার পরেই যাঁদের স্থান, তাঁরা হলেন আমার শিক্ষকেরা। পারিবারিক শিক্ষা, আদর্শ লিপি, মানবিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন তৈরিতে যাঁরা আমাকে সহায়তা করেছেন এবং তাঁদের যথাযথ শিক্ষাদানের কারণে আজ আমিও একজন শিক্ষক হতে পেরেছি। আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত শেখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। সততা, মানবিক মূল্যবোধ, যুগোপযোগী, শিক্ষার্থীবান্ধব ও ফলপ্রসূ শিক্ষাদান করার মূল লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

আজকে আমি আরও স্মরণ করছি যাদের পাঠদান করাচ্ছি আমার শিক্ষার্থীদের! শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষকের পরিপূর্ণতা লাভ করা যায় না। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একে অপরের পরিপূরক। একজন শিক্ষার্থীর আগামীর পথচলা নির্ভর করে শিক্ষকদের সঠিক দিকনির্দেশনার ওপর। বর্তমান সময়ে পত্রপত্রিকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে প্রতিবেদনে কিছু অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। অতি প্রাচীনকাল থেকে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল পবিত্র। গুরু বিদ্যা শিক্ষাও প্রচলিত ছিল; ফলে গুরুদের সম্মান ও সম্মানীর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বৌদ্ধধর্মে গুরু কর্তৃক শিষ্যের সম্পর্ক ছিল স্নেহপরায়ণ। শিষ্যদের বিপদ-আপদে সব সময় পাশে থাকতেন গুরুরা। গুরুরা সব ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠীর শিষ্যকে সমান চোখে দেখতেন ও প্রকৃত শিক্ষাদান করতেন। ফলে সে সময় বৌদ্ধ শিক্ষকেরা জনপ্রিয় ছিলেন। ভগবান গৌতম বুদ্ধের অমিয় বাণী ত্রিপিটকে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা আছে। সূত্রপিটকের অন্তর্ভুক্ত দীর্ঘনিকায়ের লোহিচ্চ সূত্রে উল্লেখ আছে, ‘বুদ্ধ সেই আচার্যকে প্রশংসা করেছেন, যিনি শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনে পারদর্শী এবং শিষ্যদের সেই পথে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করেন। আবার ক্ষুদ্রকপাঠের মঙ্গলসূত্রে উল্লেখ আছে, ‘অসবেনা চ বালানং পণ্ডিতাঞ্চ সেবনা, পূজা চ পূজনীয়, এতং মঙ্গলমুত্তমং’। অর্থাৎ অজ্ঞানীর সেবা বা সঙ্গ না করা, জ্ঞানীর সেবা করা, পূজনীয় ব্যক্তির পূজা করা উত্তম মঙ্গল।’ প্রাচীন বাংলাতে জনপ্রিয় বৌদ্ধ আচার্যের নাম হলো শান্তিরক্ষিত (নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ), অতীশ দীপঙ্কর (বিক্রমশীলা বিহারের অধ্যক্ষ) ও শীলভদ্র (নালন্দা মহাবিহার নির্মাণ করেন ও এ বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন), প্রজ্ঞাভদ্র (পণ্ডিত বিহারের আচার্য) এবং চুরাশি সিদ্ধাচার্য (চর্যাপদ রচয়িতাগণ)। তাঁরা বাংলায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসার করার পর বিশ্বে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও পাঠদান করে নন্দিত হয়েছেন এবং ইতিহাসে কালজয়ী হয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরু মর্যাদা’ কবিতা থেকে অনেকটা অনুমেয়যোগ্য! এ ছাড়া শাহ মুহম্মদ সগীরের ভাষায়, ‘ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়/ দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার’। প্রকৃত মানুষ তৈরির মহান কারিগর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও সনদেও স্বীকৃত। যাঁরা শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত বা শিক্ষা দান করেন, তাঁদের জন্য ইউনেসকো এবং আইএলও যৌথ উদ্যোগে মর্যাদাবিষয়ক সনদ তৈরি করেছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই মর্যাদাবিষয়ক সনদটি গৃহীত হয়। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রতিবছরের এই দিনে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরই দিবসটি কেন্দ্র করে একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘The transformation of education begins with teacher’ অর্থাৎ শিক্ষার পরিবর্তন শিক্ষক দিয়ে শুরু হয়।

এ ছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজকে মর্যাদার আসনে অলংকৃত করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষকদের সর্বদা সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে থাকেন। ২০১৮ সালের একুশে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গুরুজনকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তার নতুন নজির স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাংলা একাডেমির রাস্তায় রাখা লালগালিচা ছেড়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। এ সম্মান থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ অনেককেই দেখেছি সম্মান করে শিক্ষকদের সম্বোধন করেন। এ রকম হাজারো দৃষ্টান্ত দেশ-বিদেশে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকেরা জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন, যা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। সম্প্রতি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক, যিনি ক্লাসরুমে পাঠদানে ব্যস্ত ছিলেন; তখন ফোন আসে নোবেল কমিটি থেকে। তিনি সে সময় ফোন রিসিভ করেননি। পরে ক্লাস বিরতিতে ফোন ধরেন এবং খবরটি জানতে পান। এ রকম অগণিত দায়িত্বশীল শিক্ষকও রয়েছেন।

তবে সমাজে কিছু ব্যতিক্রম শিক্ষকও রয়েছেন। তাঁরা নৈতিক আদর্শের কথা ভুলে হাঁটেন উল্টো পথে। অনেক সময় ভুলেই যান তিনি সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের মানুষ বানানোর কারিগর। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য অনেকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন। মুখে শিক্ষার্থীবান্ধব বললেও কাজকর্মের গতিবিধিতে ভিন্নতা প্রকাশ পায়। এমনকি ক্লাসরুমে গিয়ে পাঠদান থেকে বিরত থেকে তাঁরা পরনিন্দা ও পরচর্চায় ব্যস্ত থাকেন। তাই শিক্ষক সমাজের প্রয়োজন এসব থেকে দূরে সরে এসে তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ থাকা। শিক্ষার্থীদের আধুনিক পদ্ধতিতে সহজ পাঠদান, সময়মতো ক্লাসরুমে উপস্থিত থাকা, গবেষণা ও সহশিক্ষায় কার্যক্রমে উৎসাহ প্রদান, নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, হতাশা থেকে কাটিয়ে তোলা, নৈতিকতা ও বিনয়ী হওয়ার মূলমন্ত্রে দীক্ষা দেওয়া এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী করে তোলাই একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ। অপর দিকে অনেক শিক্ষকের মধ্যে দুর্বলতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বতা দেখে শিক্ষার্থীরা তাদের নৈতিকতা ভুলে গিয়ে নানা সুযোগ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি ক্রমেই লোপ পাচ্ছে।

বিনা কারণে কোনো শিক্ষক দ্বারা যেন শিক্ষার্থী হয়রানি না হয়, আবার শিক্ষার্থী দ্বারাও যেন কোনো শিক্ষক লাঞ্ছিত না হয়, এটাই প্রত্যাশা। সময় হয়েছে এসব অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকার। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হোক সবকিছুর ঊর্ধ্বে। একদিন হলেও যার কাছে একটি শব্দ বা বাক্য শেখা হয়েছে, তিনি আমাদের মহান শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ না করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ভাষায় বলেছেন, ‘শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, ছাত্রদের শিক্ষা অর্জনে সক্ষম করায়।’ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষক সমাজ সচেতন হোক, তারা যথাযথ সম্মানিত হোক ও প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শবান ও অনুকরণীয় হোক এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উভয়েই সহায়ক ভূমিকা পালন করুক। এটাই শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার। ভালো থাকুক বিশ্বের সব শিক্ষক।

প্রভাষক, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়