কৈশোরের ডায়েরি

একসঙ্গে সবাই মিলে টিভি দেখাফাইল ছবি

আমার সম্পূর্ণ শৈশব কেটেছে গ্রামের শান্ত, নির্মল আর ছায়াঘেরা পরিবেশে। তখন নব্বইয়ের দশক। প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়নি। সাদাকালো টেলিভিশনে বিটিভি আর হাতের লেখা চিঠির ব্যাপক চল। যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি। সপ্তাহের শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটায় সিনেমা কিংবা সন্ধ্যাবেলা আলিফ লায়লা, সিন্দবাদ বা টিপু সুলতানের মতো শো দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকত। ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’ কিংবা ‘রূপনগর’ নাটকের সংলাপগুলো এখনো নব্বইয়ের দশকের মানুষের মুখে মুখে জীবন্ত। এসব দেখার জন্য সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা।

সবার বাড়িতে টিভি ছিল না। দু–একজনের বাড়িতে থাকত। সবাই সেই বাড়িতে ভিড় করে দেখতে যেত। পপ ও ব্র্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণযুগ ছিল সে সময়। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ইউটিউবের মতো কোনো সোশ্যাল মিডিয়া বা ভিডিও শেয়ারিং সাইট ছিল না। কিন্তু সে সময় ছিল এখনকার সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে গ্রামগঞ্জে চলত যাত্রা কিংবা পালাগানের আসর। ঈদ ও পূজা উপলক্ষে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেত নতুন নতুন সিনেমা। দল বেঁধে সবাই ছুটত সিনেমা দেখতে।

এখন বর্ষা ছেড়ে শরতে বৃষ্টি হয়। তখনকার শরৎকাল এতটা বৃষ্টিভেজা ছিল না। বৃষ্টি হলেও সামান্য। মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ ছিল না। শিউলির সুবাস, শুভ্রসাদা কাশফুল আর আকাশজোড়া সাদা মেঘের ভেলায় প্রকৃতিতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। শরৎকালে দোলা, গজ, অশ্ব কিংবা নৌকায় স্বর্গলোক থেকে পাঁচ দিনের জন্য মর্ত্যধামে আগমন করেন মা ভগবতী, সঙ্গে তাঁর চার ছেলেমেয়ে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বসত মেলা। মেলা কেন্দ্র করে প্রত্যেক বাড়িতে সমাগম হতো আত্মীয়স্বজনের। খুশিতে গমগম করত প্রতিটি বাড়ি। আজও মহাধুমধামে দুর্গাপূজা হয়। কিন্তু আগের সেই জৌলুশ আর নেই। সবকিছুতে কৃত্রিমতার ছোঁয়া। মানুষও কেমন যেন মেকি হয়ে গেছে। পূজার অন্তত এক মাস আগে থেকে চলত জমিদার ও বিত্তশালী হিন্দুবাড়িতে প্রতিমা নির্মাণের কাজ। এ কাজে পারদর্শী ছিলেন পাল সম্প্রদায় বা বিখ্যাত ভাস্কর্যশিল্পীরা। তাঁদের ভাস্কর বা কারিগর নামে ডাকা হতো। নিপুণ হাতে তাঁরা প্রতিমা নির্মাণ করতেন।

ছোটবেলায় পূজার বেশির ভাগ সময় কেটেছে মামাবাড়িতে। সেখানে হরি শীল নামের একজন ভাস্কর নিপুণ হাতে প্রতিমা গড়তেন। বড়রা সবাই তাঁকে হরি মামা আর ছোটরা দাদু বলে ডাকতাম। তিনি রসিক লোক ছিলেন। অনেক রাত অবধি প্রতিমা গড়ার কাজ করতেন। সন্ধ্যা হলে লোকজন ভিড় জমাত তাঁর কাছে রূপকথার গল্প শোনার জন্য। কেরোসিনের পিদিম জ্বালিয়ে তিনি হাতে কাজ করতেন আর মুখে সরস সেসব গল্প শোনাতেন। আগ্রহী শ্রোতারা গভীর মনোযোগে তা শ্রবণ করে হা–হুতাশ করতেন। কখনো কখনো গল্পের তাগিদে হরি দাদু আপনমনে গেয়েও উঠতেন। আজ আর সেদিন নেই। হরি দাদু মারা গেছেন বহু বছর হয়েছে। তা ছাড়া এখন আর এত মনোযোগ দিয়ে সেসব কাহিনি শোনার মানুষও নেই।

বিজলি বাতির আলোয় চাপা পড়ে গেছে কেরোসিনের কুপি। সিনেমা হলে এখন আর কেউ সিনেমা দেখে না। দর্শকশূন্যতায় বন্ধ হয়ে গেছে বেশির ভাগ সিনেমা হল। ফেসবুকে সবাই সস্তা বিনোদন খোঁজে। অনাদরে–অবহেলায় হারিয়ে গেছে কৈশোরের রঙিন দিনগুলো। চাপা পড়ে আছে মলিন ধূসর ডায়েরির পাতায়। এখনকার দিনে কিশোরবেলা কাটে মুঠোফোনে গেমস খেলে। বনবাদাড় কিংবা মাঠঘাটে কেউ খেলাধুলা করে না। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলে না। ছিপ ফেলে মাছ শিকার করে না। মানুষের গাছের ফলফলাদি চুরি হয় না। সম্পর্কগুলোও কৃত্রিমতায় ভরে গেছে। আন্তরিকতায়ও ভাটা পড়েছে। দলাদলি, গ্রুপিং আর কোন্দল করে কিশোরেরা মারামারি, খুন–জখমসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে এখন অনেক কিশোর গ্যাং তৈরি হয়েছে। মুরব্বি ও শিক্ষকদের সম্মান করার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।