রাত ১১টার পরই মফস্বল শহরের চারদিক মোটামুটি নীরব হয়ে যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও নিস্তব্ধতায় আছন্ন হয় মাইজদী শহর। মধ্যরাতে রাস্তায় উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়ানোয় একধরনের মজা পাওয়া যায়। কিন্তু নানা ব্যস্ততার ভেতর আজকাল ইচ্ছা থাকলেও রাতে না ঘুমিয়ে বাইরে এদিক-ওদিক হাঁটার সুযোগ পাওয়া মুশকিল। তবে ওই যে, একটা কথা আছে না! ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। গত ১ মে রাতে ঢাকায় যাওয়া উপলক্ষে তেমনি একটি সুযোগ হয়ে গেল।
তবে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় হেঁটে যাওয়ার সাহস দেখাইনি। সাহস দেখাতে গেলে আমার আর পরদিন শুক্রবার সকাল ৯টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘লেখক বন্ধু উৎসবে’ অংশগ্রহণ করা হতো না।
ঢাকার উদ্দেশে বাস ছাড়ার কথা রাত ২টা ৩৫ মিনিটে। আগে আগে ঘুমালে এ সময়ের মধ্যে ঘণ্টা দুই-তিনেক ঘুমানো যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, আমার একবার ঘুম এসে গেলে একঘুমেই ভোরের আলো ফুটে রোদ উঠে যাবে। ঘুমের মধ্যে হয়তো স্বপ্ন দেখব, আমি লেখক বন্ধু উৎসবে চলে এসেছি; সবার সঙ্গে গল্প করছি। ঘুম ভাঙলেই টের পাব, আমি তো নিজের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। তাই আর ঘুমানোর ঝুঁকি নিলাম না। রাত ১০টায় বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাসে ওঠা অবধি আমাকে সঙ্গ দিতে আমার ডাকে সাড়া দিলেন নোয়াখালী বন্ধুসভার পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক তাজকির হোসেন ও কার্যনির্বাহী সদস্য ধ্রুব ভূঁইয়া। অবশ্য সংগঠনের বাইরেও এ দুজন আমার বেশ ভালো বন্ধু। তিনজন মিলে হাঁটা শুরু করলাম। শহরের অলিগলি বিচরণ করলাম। টঙে বসে চা খেলাম। গল্প করলাম। আকাশে ফুটফুটে গোল চাঁদটার জন্য শহরটাকে আরও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল।
কখন যে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। তাজকির ও ধ্রুবকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠলাম। বাস ছাড়ার পর ওদের মিস করছিলাম। নিজেকে একা মনে হচ্ছিল। বাস দুর্বারগতিতে ছুটে চলছে। রাত আর বাসের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে বোধ হয়। রাত যত গভীর হয়, বাসের গতি তত বাড়তে থাকে। এদিকে, আমার এখন গভীর ঘুম দরকার। চেষ্টা করলাম। জানালা দিয়ে বাতাস এসে গায়ে মাখছে। কানে বাজছে গান। কিন্তু ঘুম আর এল না। একটু পরপর বাসের লম্বা হর্ন ও হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক কষায় বারবার ঘুম ভাঙছিল।
সকাল সাড়ে ছয়টায় রাজধানীর রামপুরায় নামলাম। ওখান থেকে হাতিরঝিল হয়ে কারওয়ান বাজারে যাব। হাতিরঝিল লেকের পাশ দিয়ে আমার রিকশা ছুটছিল। সকাল সকাল হাতিরঝিলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
কারওয়ান বাজারে পৌঁছালাম। এত সকালে কখনো কারওয়ান বাজারে আসিনি এর আগে। কাঁচাবাজারের ক্রেতা–বিক্রেতাদের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেলাম। যেন কাঁচাবাজার একটা বিশাল মেলা।
এরপর প্রথম আলো অফিসে যাই। রিসিপশনে এসে জানলাম, এখনো বন্ধুসভার কেউ আসেনি। আমিই সবার আগে এলাম। এ সুযোগে হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। রিসিপশনের এক কর্মচারী খাতায় নাম লেখার সময় ঠিকানা নোয়াখালী দেখে বললেন, ‘আপনি নোয়াখালী থেকে আসছেন? আমার বাড়িও ভাই নোয়াখালী।’ লোকটি আমার খোঁজখবর নিলেন। কীভাবে কোন কক্ষে যেতে হবে দেখিয়ে দিলেন। যদিও প্রথম আলো অফিসে অনেকবার আসার সুবাদে সবকিছু মোটামুটি চেনাজানা ছিল। নিজ জেলার মানুষ বলে লোকটা খাতির–যত্ন করছিলেন।
ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। পরিচয় হলো চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধু নাজিফা তাজনুরের সঙ্গে। কথায় কথায় জানলাম, তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম কিশোর আলো বুক ক্লাবের সমন্বয়ক। আমিও একসময় নোয়াখালী কিশোর আলো বুক ক্লাবের সমন্বয়ক ছিলাম। সে সুবাদে তাঁর সঙ্গে গল্প জমল বেশ। একটু পর এলেন ভৈরব বন্ধুসভার সভাপতি নাহিদ হোসেন, নীলফামারী বন্ধুসভার সভাপতি নিপুণ রায়। তাঁদের সঙ্গেও গল্প হলো। ধীরে ধীরে অন্যান্য বন্ধুসভার নির্বাচিত লেখক বন্ধুরাও উপস্থিত হলেন।
সকাল ৯টায় ক্যানটিনে সবাই মিলে নাশতা করতে গেলাম। আমরা এক টেবিলে বসি ছয় জেলার ছয় বন্ধু। নিজ জেলা ও বন্ধুসভা নিয়ে খানিক আলাপ জমল। নাশতা শেষে গন্তব্য ১০ তলায় প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে।
জাতীয় সংগীতের পর শুরু হলো মূল আলোচনা। ততক্ষণে রাতে না ঘুমানোর পরিণাম কী হতে পারে, তা টের পাচ্ছিলাম। চোখ খোলা রাখাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। প্রথম আলোচক হিসেবে মঞ্চে এলেন কবি ও সাংবাদিক সাজ্জাদ শরিফ। আমাদের নিয়ে গেলেন কবিতার অন্য এক জগতে। কবিতার ঢেউয়ের তালে আমার ঘুম যেন কোথায় হারিয়ে গেল। শুনতে থাকলাম কবিতার গল্প।
কবি ও লেখক শাহনাজ মুন্নী করলেন ছোট গল্প নিয়ে গল্প। গল্প শেষে মঞ্চে এলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। বরাবরের মতোই তাঁর কথাগুলো শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।
মধ্যাহ্নভোজের আগে পেলাম অভাবনীয় এক চমক। আগেই বলা হয়েছিল লেখক বন্ধু উৎসবে ‘সেরা ১০ লেখক বন্ধু’র নাম ঘোষণা ও সম্মাননা প্রদান করা হবে। জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ও অনুষ্ঠান সঞ্চালক জাফর সাদিক ভাই সেরা ১০ জনের নাম ঘোষণা করার জন্য তৈরি হলেন। তিনি প্রথম নামটি ঘোষণা করলেন, ‘আসিফ আহমেদ, নোয়াখালী বন্ধুসভা।’ আমি হতচকিত। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে সেরা দশের মধ্যে জায়গা করে নেব। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কবি আনিসুল হক আমার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিলেন। কিশোর আলোর সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আনিসুল হক স্যারের হাত থেকে এর আগেও অনেকবার পুরস্কার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে এবারের অনুভূতি অন্য রকম।
এ বছরের জানুয়ারিতে নোয়াখালী বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। শপথ গ্রহণের দিন বলেছিলাম, নোয়াখালী বন্ধুসভাকে সেরা ১০টি বন্ধুসভার মধ্যে দেখতে চাই। সেটা হবে কি না, তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সেরা ১০ লেখক বন্ধুর একজনের স্বীকৃতি পেলাম। এটি আমাকে সাংগঠনিকভাবেও দারুণ অনুপ্রেরণা দেবে।
কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মধ্যাহ্নভোজ শেষে শুরু হলো পরবর্তী পর্ব। লেখালেখির বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে কথা বলেন প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক আলতাফ শাহনেওয়াজ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল। আলতাফ শাহনেওয়াজ ফিচারকে বিভিন্ন রঙে লেখার কৌশল বাতলে দেন। তাঁর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় নতুন অনেক কিছু জানলাম।
দিনভর লেখালেখি নিয়ে দারুণ সব আলোচনা শেষে বিকেল পাঁচটায় বিদায় নেওয়ার পালা। সারা দেশ থেকে আসা লেখক বন্ধুদের সঙ্গে সারা জীবন মনে রাখার মতো কিছু সময় কাটালাম। সবাইকে বিদায় জানিয়ে প্রথম আলো অফিস থেকে বের হই। বের হওয়ার সময় রিসিপশনের ওই লোকটাকে খুঁজলাম। তাঁর আর দেখা পেলাম না।
কারওয়ান বাজার থেকে বাসে করে সায়েদাবাদ আসি। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে নোয়াখালীর উদ্দেশে বাসে উঠে বসলাম। ততক্ষণে সকালে বিদায় নেওয়া সেই ঘুম আবার হাজির। কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছা করছিল না। মনে একটা ভয় উঁকি দিচ্ছিল। যদি ঘুম ভাঙার পর দেখি, আমি বাসায় নিজের বিছানায় শুয়ে আছি! এতক্ষণ যা যা হলো, সবই আমার স্বপ্ন!
সাধারণ সম্পাদক, নোয়াখালী বন্ধুসভা